পরাশক্তি রোমের বিরুদ্ধে ইয়ারমুকের যুদ্ধের একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা ও তার থেকে কিছু শিক্ষা
১৩ হিজরিতে সেকালের পরাশক্তি রোম -এর সাথে মুসলিমদের 'ইয়ারমুকের' জিহাদ চলাকালে জিহাদের ময়দানে রোমের এক বিখ্যাত সেনাপতি জুরজা সৈন্যদের সারি থেকে বেরিয়ে এসে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) এর সাথে কথা বলার প্রস্তাব দিলে দুই জনই কাছাকাছি আসেন।
জুরজা ও খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) এর মাঝে কথা চলছিলঃ
জুরজাঃ হে খালিদ,আপনি আমার সাথে সত্য কথা বলবেন, মিথ্যা নয়। কারণ স্বাধীন ও সাহসী ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলেন না। আমার সাথে প্রতারণা করবেন না। কারণ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি প্রতারণা করেন না। বলুন তো, আল্লাহ তা'য়ালা কি আপনাদের নবীর নিকট আকাশ থেকে কোন তরবারি নাযিল করেছিলেন যে, নবী নিজে ওই তরবারি আপনাকে হস্তান্তর করেছেন। আর আপনি ওই তরবারি যার উপর চালান সে-ই পরাজিত হয়--- পরাস্ত হয়।
খালিদ (রাঃ): না, তা তো নয়। আল্লাহ সরাসরি কোন তরবারি নাযিল করেন নি।
জুরজাঃ তাহলে আপনাকে সায়ফুল্লাহ---- আল্লাহর তরবারি বলা হয় কেন?
খালিদ (রাঃ): আল্লাহ আমাদের নিকট তার নবীকে প্রেরন করেছেন। তিনি আমাদের আল্লাহর পথে ডেকেছেন, আমরা সকলে তার নিকট থেকে পালিয়ে ছিলাম এবং দূরে বহু দূরে সরে গিয়েছিলাম। এরপর আমাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ তাকে সত্য বলে মেনে নেয় এবং তার অনুসরন করে। কতক তাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং দূরে চলে যায়, আমি ছিলাম তাদের দলে। এরপর আল্লাহ আমাদের কপাল চেপে ধরলেন এবং তার মাধ্যমে আমাদের হিদায়াত ও সৎ পথ দেখিয়েছেন। আমরা তার হাতে বায়াত করেছি। তার অনুসরনের অঙ্গিকার করেছি। রাসুল (সাঃ) আমাকে বললেন, তুমি আল্লাহর একটি তরবারি, এই খোলা তরবারি আল্লাহ তা'য়ালা মুশরিকদের উপর নিয়োজিত করে দিয়েছেন। তিনি আমাকে সাহায্য করার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দুয়া করলেন। আর আমি মুশরিকদের জন্য সর্বাধিক কঠোর বাক্তি।
জুরজাঃ আপনারা কোন বিষয়ের দিকে মানুষকে ডাকেন?
খালিদ (রাঃ): আমরা ডাকি এই বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য যে, আল্লাহ ব্যতিত কোন ইলাহ নেই, আর মুহাম্মদ (সাঃ) তার বান্দা ও রাসুল এবং এ বিষয়ে স্বীকৃতি দিবে যে, মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যা নিয়ে এসেছেন তা সত্য।
খালিদ (রাঃ): আমরা ডাকি এই বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য যে, আল্লাহ ব্যতিত কোন ইলাহ নেই, আর মুহাম্মদ (সাঃ) তার বান্দা ও রাসুল এবং এ বিষয়ে স্বীকৃতি দিবে যে, মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যা নিয়ে এসেছেন তা সত্য।
জুরজাঃ যদি কেউ আপনাদের ডাকে সারা না দেয়, তার কি অবস্থা হবে?
খালিদ (রাঃ): তাহলে সে জিযিয়া কর দিবে এবং বিনিময়ে আমরা তার জান-মালের নিরাপত্তা দিব।
জুরজাঃ যদি সে জিযিয়া দিতে অস্বীকৃতি জানায়?
খালিদ (রাঃ): তাহলে আমরা তার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা দিব এবং তার বিরুদ্ধে জিহাদ করব।
জুরজাঃ আজকের এই মুহূর্তে যদি কেউ আপনাদের ডাকে সারা দেয় এবং ইসলামে প্রবেশ করে তবে তার কি অবস্থা হবে?
খালিদ (রাঃ): তাহলে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারে সে এবং আমরা সকলের অবস্থান এক হয়ে যাবে। সে আমাদের সমমর্যাদার হয়ে যাবে। আশরাফ-আতরাফ, উচু-নিচু ও পূর্ববর্তী-পরবর্তী সব একই মর্যাদার অধিকারী হবে।
জুরজাঃ যে ব্যক্তি আজ ইসলাম গ্রহন করবে, আপনাদের দলভুক্ত হবে তার আর আপনাদের সওয়াব ও পুণ্য কি এক সমান হবে?
খালিদ (রাঃ): হা তাই হবে। তবে সে আরও উত্তম পুণ্য পাবে।
জুরজাঃ ওই বাক্তি কিভাবে আপনাদের সমান হবে অথচ ইসলাম গ্রহনে আপনারা তার চেয়ে অগ্রবর্তী ও পুরাতন?
খালিদ (রাঃ): আমরা ইসলাম গ্রহন করেছি বাধ্য হয়ে। তারপর আমরা নবী (সাঃ) এর হাতে বায়াত করেছি যখন তিনি জীবিত ছিলেন। তার কাছে আসমান থেকে সংবাদ আসত। তিনি আমাদের কুরআনের আলোকে বিভিন্ন বিষয় জানাতেন। তিনি আমাদের বিভিন্ন নিদর্শন ও মু'জিযা দেখাতেন। আমরা যা দেখেছি কেউ তা দেখলে এবং আমরা যা শুনেছি কেউ তা শুনলে সে ইসলাম গ্রহনে ও বায়াত সম্পাদনে বাধ্য হয়ে পড়ে। ইসলাম গ্রহন ও বায়াত সম্পাদন তার কর্তব্য হয়ে যায়। আমরা যে সব আশ্চর্যজনক ঘটনা ও প্রমাণাদি শুনেছি আপনারা তা শুনেন নি। তসত্ত্বেও আপনাদের কেউ যদি খাঁটি নিয়তে ----স্বচ্ছ বিশ্বাসে এই ইসলামে প্রবেশ করে সে আমাদের চাইতে উত্তম হবে না বা কেন?
জুরজাঃ আল্লাহর কসম আপনি সত্য বলছেন তো? প্রতারনা করেন নি তো?
খালিদ (রাঃ): আল্লাহর কসম! আমি আপনার নিকট সত্য বলছি এবং আল্লাহ সম্পর্কে আপনি যা, জিজ্ঞাসা করেছেন , আমি যা বলেছি সে সম্পর্কে আল্লাহ অবগত আছেন।
তখনি জুরজা ঢাল উল্টিয়ে ধরেন এবং খালিদ খালিদ (রাঃ) এর দিকে ঝুকে পড়েন।
জুরজাঃ আপনি আমাকে ইসলাম শিখিয়ে দিন।
জুরজাকে নিয়ে তখন খালিদ তাবুতে গেলেন, মশক থেকে পানি ঠেলে ওজু করিয়ে তাকে নিয়ে ২ রাকআত নামাজ পড়েন। জুরজা এরপর খালিদ (রা) এর সাথে ময়দানে ফিরে রোমানদের বীরুদ্ধে জিহাদে অংশগ্রহণ করেন এবং কিছুক্ষন পর প্রচণ্ড আক্রমণ করতে করতে এক সময় আহত হয়ে শহীদ হন। ....... খালিদ (রাঃ) এর সাথে ২ রাকআত নামজই ছিল তার জীবনের প্রথম ও শেষ নামাজ। কিন্তু রোমানদের বীরুধে মুসলিমদের সাথে জিহাদে আল্লাহ তাকে কবুল করেছিলেন, এবং তাকে সর্বোচ্চ সম্মানি মৃত্যু শহীদ হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন।
মূলত যেখানে আমরা জন্মগত ভাবে পাওয়া মুসলিমরা জন্মগত ভাবে পাওয়া জীবনবিধান ইসলাম-এর ফরজ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করি, সেখানে এই মুসলিম ভাইটি তো চরম ঈমানের পরিচয় দেখিয়েছেন। খ্রিষ্টান থেকে ইসলাম গ্রহন করার পরই তার উপর অর্পিত ফরজ দায়িত্ব পালনে তিনি একটুও সময় নষ্ট করেন নি। আল্লাহর প্রতি ঈমান তার থেকে মৃত্যুর ভয়কেও পরাজিত করেছে। অথচ, সেই ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলিমদের থেকে রোমানদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। রোমানদের ছিল ২লক্ষ সৈন্য, আর মুসলিমদের ছিল মাত্র ২১ হাজার মুজাহিদ। সে যুদ্ধে মুসলিমদের ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল অনেক । যুদ্ধের ময়দান থেকে কিছু কিছু অধৈর্য ও পরিশ্রান্ত মুসলিম পালিয়ে যাওয়ার সময় মহিলাদের হাতে পাথর নিক্ষেপ ও কাঠের বাড়ি খেয়ে লজ্জায় ময়দানে ফিরে আসে। মহিলাদেরকে এজন্যই নিযুক্ত করা হয়েছিল যেন তারা ভয়ে পালিয়ে যাওয়া মুজাহিদদের ময়দানে ফিরিয়ে আনে। এছাড়াও মহিলারা এ যুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণ করে। অবশেষে মুসলিমরাই প্রতিবারের মত কাফিরদের বিরুদ্ধে জয় লাভ করেন।
অবশেষে আমার মুসলিম ভাই-বোনদের সুরা রা’দ-এর ২৭ নং আয়াতটি মনে করিয়ে দিয়ে শেষ করতে চাই, ....... “....... বলুন, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ ভ্রষ্ট করেন এবং তিনি তাকে নিজের দিকে পথ প্রদর্শন করেন --- যে তার অভিমুখী হয়”।
আরেকটি প্রাসঙ্গিক আয়াত সংযোজন করতে ইচ্ছে করছে, ..... “যেসব মুসলমান কোন প্রকার অক্ষমতা ছাড়াই ঘরে বসে থাকে আর যারা ধন-প্রাণ দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে, তাদের উভয়ের মর্যাদা সমান নয়। যারা ঘরে বসে থাকে তাদের তুলনায় জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের মর্যাদা আল্লাহ বুলন্দ করেছেন। যদিও সবার জন্য আল্লাহ কল্যাণ ও নেকীর ওয়াদা করেছেন, তবুও তাঁর কাছে মুজাহিদদের কাজের মর্যাদা ঘরে বসে থাকা লোকদের তুলনায় অনেক বেশী৷ তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রয়েছে বিরাট মর্যাদা, মাগফেরাত ও রহমত ৷ আর আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়”। [সুরা নিসাঃ ৯৫-৯৬]
[সুত্রঃ "আল বিদায় ওয়ান নিহায়া" , ৭ম খণ্ড, "ইয়ারমুকের যুদ্ধ" পরিচ্ছেদ ......... আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ- দামেশকী (র) ("তাফসীরে ইবনে কাসীর" -এর লেখক) । ------ এই বইটি একটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক গ্রন্থ যেখানে হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে খলীফাদের জীবনী পর্যন্ত বহু কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।]

0 on: "পরাশক্তি রোমের বিরুদ্ধে ইয়ারমুকের যুদ্ধের একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা ও তার থেকে কিছু শিক্ষা"