Saturday, May 21, 2016

কিছু প্রচলিত ভুল



কিছু প্রচলিত ভুল
 
একটি রসম : কালিমার মাধ্যমে দুআ শেষ করা  
দুআর একটি আদব হল, আল্লাহর হামদ-ছানা (প্রশংসা) ও দরূদ শরীফ দ্বারা দুআ শুরু করা এবং শেষ করা। তাছাড়া হাদীস থেকে এ-ও বুঝা যায় যে,দুআ সমাপ্ত হবে আমীন-এর মাধ্যমে । কিন্তু অনেক মানুষকে দেখা যায়, তারা দুআ শেষ করেন কালিমার মাধ্যমে। এভাবে বলে থাকেন-
হে আল্লাহ! মৃত্যুর সময় যবানে জারি করে দিও- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ  অথবা বলেন,
اجعل آخر كلامنا عند الموت "لا إله إلا الله، محمد رسول الله".
অর্থাৎ কালিমার মাধ্যমে তারা দুআ শেষ করেন। এটি দুআর আদব নয়; বরং এর কারণে দুআ সমাপ্ত করার মাসনূন আমল ছুটে যায়।
হাঁ,দুআর মধ্যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থনা যে, হে আল্লাহ আমার শেষ কথা হোক তোমার কালিমা। হাদীস শরীফে এসেছে-
مَنْ كَانَ آخِر كَلَامِهِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ.
যার শেষ কথা হবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ সে জান্নাতে যাবে। -সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস ৩১১৬
কিন্তু কালিমার মাধ্যমে দুআ শেষ করা একটি রসম মাত্র।
(http://www.alkawsar.com/article/1342)

এটি কি হাদীস : সালাম দিলে নববই নেকী আর জওয়াব দিলে দশ নেকী
উপরের কথাটা বেশ প্রসিদ্ধ। কেউ কেউ প্রশ্ন করে থাকেন যে, এটা হাদীস কি না? আমাদের জানামতে এ কথাটা হাদীসের প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহে নেই। বরং একটি সহীহ হাদীসে এসেছে যে, সালামে শুধু আস্সালামু আলাইকুম বললে দশ নেকী, ওয়া রাহমাতুল্লাহ বৃদ্ধি করলে বিশ নেকী এবং ওয়া বারাকাতুহ সহ পুরো সালাম বললে ত্রিশ নেকী পাওয়া যায়।
দেখুন : সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ৫১৫৩, জামে তিরমিযী হাদীস : ২৬৮৯
এজন্য ওই প্রচলিত কথাটির পরিবর্তে উপরোক্ত হাদীসে উল্লেখিত বিষয়টি প্রচার করা উচিত। 
(http://www.alkawsar.com/article/1627)

এটি কি হাদীস : আসসালাতু মিরাজুল মুমিনীন
নামায মুমিনের মেরাজ কথাটা একটা প্রসিদ্ধ উক্তি। কেউ কেউ একে হাদীস মনে করে থাকেন। কিন্তু হাদীসের প্রসিদ্ধ কিতাবসমূহে এটা পাওয়া যায় না। তবে এ কথাটার মর্ম বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে আহরণ করা যায়। এ জন্য একথাটা একটি প্রসিদ্ধ উক্তি হিসেবেই বলা উচিত, হাদীস হিসেবে নয়। হাদীস বলতে হলে নিম্নোক্ত কোনো সহীহ হাদীস উল্লেখ করা যায়- মুমিন যখন নামাযে দাড়ায় তখন সে তার রবের সঙ্গে একান্তে কথা বলে। সহীহ  বুখারী, হাদীস ৪১৩
তোমাদের কেউ যখন নামাযে দাড়ায় তখন সে আল্লাহর সঙ্গে একান্তে কথা বলে, যতক্ষণ সে তার জায়নামাযে থাকে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪২৬

এটা কি হাদীস? দুই লক্ষ চবিবশ হাজার?
নবীগণের মধ্যে সর্বপ্রথম হলেন হযরত আদম আ. এবং সর্বশেষ নবী ও রাসূল হলেন খাতামুন্নাবিয়্যীন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর মাধ্যমেই আল্লাহ তাআলা নবুওয়ত ও রিসালাতের ধারাবাহিকতা সমাপ্ত করেছেন। তাঁর পরে আর কোনো নতুন নবী বা নতুন রাসূল নেই। এই দুজন এবং এঁদের মধ্যে আরও যত নবী-রাসূল আগমন করেছেন তাঁদের সবার প্রতি আমাদের ঈমান রয়েছে। বিশেষত যাদের নাম আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে উল্লেখ করেছেন তাদের উপর আমরা সুনির্দিষ্টভাবে ঈমান রাখি যে, তাঁরা আল্লাহর সত্য নবী এবং প্রিয় বান্দা। আর যাঁদের নাম ও ঘটনা কুরআন-হাদীসে উল্লেখিত হয়নি আমরা তাদের সম্পর্কে নাম-পরিচয়ের সুনির্দিষ্টতা ছাড়াই ঈমান রাখি।
آمنت بالله وملائكته وكتبه ورسله
আমরা ঈমান রাখি আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাগণের উপর, তাঁর কিতাবসমূহের উপর, তাঁর রাসূলগণের উপর।
কিন্তু প্রশ্ন এই যে, হযরত আদম আ. থেকে আখেরী  নবী  হযরত  মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সর্বমোট কতজন নবী এসেছেনআসলে এর সংখ্যা জানা অপরিহার্য নয়। তাছাড়া এ প্রসঙ্গে রেওয়ায়েতও বিভিন্ন ধরনের। তবে একটি সংখ্যা এ প্রসঙ্গে অর্থাৎ দুই লক্ষ চবিবশ হাজারও উল্লেখ করা হয়। এ সম্পর্কে অনেকেই প্রশ্ন করেন যে, এ সংখ্যা কোনো রেওয়ায়েতে এসেছে কি না? এসে থাকলে তা কোন কিতাবে আছে?

আমি এটা অনেক তালাশ করেছি, কিন্তু কোথাও পাইনি। শেষে মোল্লা আলী কারী রাহ.-এর ইকদুল ফারাইদ ফী তাখরীজি আহাদীছি শরহিল আকাইদ-গ্রন্থে (ক্রমিক নং ৩৭) এ উক্তি পেলাম যে, হাফেয জালালী রাহ. বলেছেন-
لم أقف عليه
অর্থাৎ এ কথা আমি কোনো রেওয়ায়েতে পাইনি।

এটি হাদীস নয় : আশুরার দিন কিয়ামত হওয়া প্রসঙ্গে
আশুরা দিবসের গুরুত্ব আলোচনা করতে গিয়ে অনেকে বলে থাকেন যে, হাদীস শরীফে এসেছে, এই দিনে কিয়ামত সংগঠিত হবে। এই কথাটা ঠিক নয়। যে বর্ণনায় আশুরার দিন কিয়ামত হওয়ার কথা এসেছে তা হাদীস বিশারদদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভিত্তিহীন, জাল।
আল্লামা আবুল ফরজ ইবনুল জাওযী ওই বর্ণনা সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, এটা নিঃসন্দেহে মওযূ বর্ণনা ...। হাফেয সুয়ূতী রাহ. ও আল্লামা ইবনুল আররাক রাহ.ও তাঁর ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়েছেন।
(কিতাবুল মওযূআত ২/২০২; আল লাআলিল মাসনূআ ২/১০৯; তানযীহুশ শরীআতিল মরফূআ ২/১৪৯)
তবে জুমআর দিন কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার কথা সহীহ হাদীসে এসেছে। দেখুন-তিরমিযী ২/৩৬২; আবু দাউদ ১/৬৩৪; সুনানে নাসায়ী ৩/১১৩-১১৪

একটি ইতিহাস বিষয়ক ভুল : আবু জাহল কি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা ছিল
আরবের মুশরিক গোষ্ঠীর নেতা আবু জাহল, ইসলামের সঙ্গে তার শত্রুতা এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি বিদ্বেষ ও বেআদবী সর্বজনবিদিত। তার সম্পর্কে কোনো কোনো মানুষকে বলতে শোনা গেছে যে, সেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা ছিল, যেভাবে আবু লাহাব তাঁর চাচা ছিলেন। এটা ভুল। আবু লাহাব খাজা আবদুল্লাহর ভাই এবং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা ছিলেন। কিন্ত আবু জাহল কোরাইশ বংশের লোক হলেও আবদুল মুত্তালিবের সন্তান ছিল না। আবু জাহলের বংশধারা এই-‘‘আবু জাহল আমর ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমর ইবনে মাখ্যুম’’(উমদাতুল কারী, খন্ড : ১৭, পৃষ্ঠা : ৮৪)

এটি হাদীস নয়: আঠারো হাজার মাখলুকাত
উপরের কথাটি লোকমুখে এতই প্রসিদ্ধ যে, অনেকের কাছে তা কুরআন-হাদীসের বাণীর মতো স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু মাখলুকাতের এই নির্দিষ্ট সংখ্যা না কুরআনে আছে, না কোনো সহীহ হাদীসে। বাস্তবতা হল, আল্লাহ তাআলা অগণিত মাখলুক পয়দা করেছেন। জলে ও স্থলে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাখলুক আল্লাহর অসীম কুদরতের প্রমাণ। মানুষের জানার বাইরেও রয়েছে অসংখ্য মাখলুক। আল্লাহ তাআলা কত ধরনের মাখলুক সৃষ্টি করেছেন তার নির্দিষ্ট সংখ্যা সহীহ হাদীসে বলা হয়নি। একটি মুনকার বর্ণনায় এর সংখ্যা এক হাজার বলা হয়েছে। কিন্তু অনেক মুহাদ্দিস বর্ণনাটিকে মাওযূ বা জাল বলে আখ্যা দিয়েছেন। (আলমাওযূআত, ইবনুল জাওযী ২/২১৬; আলফাওয়াইদুল মাজমুআ পৃ. ৪৫৮-৪৫৯) এছাড়া এই সংখ্যা সম্পর্কে কিছু মনীষীর উক্তিও রয়েছে। যেমন মারওয়ান ইবনুল হাকামের কথামতে সতের হাজার জগত রয়েছে। আর আবুল আলিয়ার অনুমান অনুযায়ী চৌদ্দ হাজার কিংবা আঠারো হাজার মাখলুকাত আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এই বিভিন্ন সংখ্যা কিছু মনীষীর উক্তিমাত্র, হাদীস নয়। দ্বিতীয়ত তাদের বক্তব্য থেকেও অনুমিত হয় যে, নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা বোঝাতে নয়; বরং আধিক্য বোঝাতেই তারা এ সব কথা বলেছেন। তাও আবার অনুমান করে। এই কারণে এর কোনোটিকেই প্রমাণিত সত্য মনে করার কোনো কারণ নেই; বরং এ বিষয়ে ইবনে কাসীর রাহ.-এর কথাটিই মূল কথা, যা তিনি আবুল আলিয়ার পূর্বোক্ত কথাটি পূর্ণভাবে উদ্ধৃত করার পর বলেছেন। আর তা হল, هذا كلام غريب يحتاج مثل هذا إلى دليل صحيح অর্থাৎ এটি এমন একটি আজব কথা, যার জন্য বিশুদ্ধ দলীলের প্রয়োজন রয়েছে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/২৬) অতএব আঠারো হাজার নয়; বরং বলা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা অসংখ্য অগণিত মাখলুক পয়দা করেছেন, যা আমরা গুণে ও হিসাব করে শেষ করতে পারব না।



একটি ভুল বিশ্বাস: আলোচনা চলাকালে উপস্থিত হলে হায়াত দীর্ঘ হয়!
অনুপস্থিত কোনো  ব্যক্তিকে নিয়ে কথা চলছে এমন সময় সে উপস্তিত হলে অনেককে বলতে শোনা যায় যে, তুমি লম্বা হায়াত পাবে, আমরা তো তোমার কথাই আলোচনা করছিলাম!
এই ধরনের কথা এত বেশি প্রচলিত যে, শুনে মনে হতে পারে, তা একটি স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। কিন্তু সামান্য চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে, এর সাথে হায়াত বাড়া-কমার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বিশ্বাস। শরীয়তে যেমন এর কোনো ভিত্তি নেই তেমনি বিবেক-বুদ্ধিও এই ধরনের অলীক ধারণা সমর্থন করে না। অতএব এ ধরনের বিশ্বাস পোষণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

এটি হাদীস নয়: মাদরাসা রাসূলের ঘর
কোনো কোনো ওয়াজমাহফিলে এই ধরনের কথা শোনা যায় যে, মসজিদ আল্লাহর ঘর আর মাদরাসা রাসূলের ঘর। আবার কোনো কোনো দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তা আরেকটু আগে বেড়ে এটাকে হাদীস হিসেবে এভাবেও বর্ণনা করেন যে,
المسجد بيت الله والمدرسة بيتي
মসজিদ আল্লাহর ঘর আর মাদরাসা আমার ঘর।
এখানে লক্ষণীয় যে, উপরোক্ত কথায় দুটি বাক্য রয়েছে। প্রথম বাক্যটি হল, মসজিদ আল্লাহর ঘরএটি কুরআন ও হাদীস দ্বারা সমর্থিত । প্রায় এর কাছাকাছি শব্দ বিভিন্ন হাদীসেও বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বাক্য অর্থাৎ মাদরাসা রাসূলের ঘর এটি কোনো হাদীস নয়। কেউ এটাকে হাদীস হিসেবে বললে ঠিক হবে না। তবে একথা বলাই বাহুল্য যে, মাদরাসা যেখানে দ্বীনি তালীম-তরবিয়ত হয়, কুরআন-হাদীসের শিক্ষা দেওয়া হয়, আল্লাহ ও রাসূলের কথা আলোচনা হয় তা নিঃসন্দেহে মুবারক স্থান। এ সকল স্থান ফেরেশতারা ঘিরে রাখেন এবং সেখানে আল্লাহর রহমত ও সাকীনা নাযিল হয়। অতএব ঐসব ঘরও আল্লাহ ও রাসূলেরই ঘর। কিন্তু তাই বলে মাদরাসা রাসূলের ঘর বাক্যটিকে হাদীস হিসেবে বলার সুযোগ নেই। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথাটি বলেছেন তার কোনো প্রমাণ নেই। আর মসজিদ-মাদরাসার মধ্যে এভাবে বিভাজনও অনুচিত।

একটি শব্দের অর্থহীন প্রয়োগ: রূহ বা বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা
মৃত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাতের দুআর ক্ষেত্রে মরহুমের রূহ কিংবা বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা জাতীয় শব্দ ব্যবহারের প্রচলন আছে।
মরহুমের জন্য মাগফিরাতের দুআ করা একটি নেক আমল। হাদীস শরীফে এ আমলের তারগীব দেওয়া হয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে অনেক মাসনূন দুআও হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। অতএব মরহুমের জন্য মাগফিরাতের দুআ করা উচিত। কিন্তু বিষয়টিকে মরহুমের রূহ বা বিদেহী আত্মার সাথে যুক্ত করার কী অর্থ?
মাগফিরাত কামনার অর্থ হল, আল্লাহ যেন তার গুনাহখাতা মাফ করে দেন, এই দুআ করা। গুনাহ যেমন মানুষের আভ্যন্তরীণ নফস দ্বারা হয় তেমনি বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারাও হয়। তদ্রূপ আল্লাহ তাআলা না করুন-দুনিয়ার এইসব গুনাহখাতার জন্য যদি আখিরাতের আযাব ভোগ করতে হয় তাহলে রূহ যেমন তা ভোগ করবে তেমনি দেহও যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, তা ভোগ করবে। এটিই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আকীদা। একইভাবে নেয়ামত, সুখ-শান্তি ও দেহ-আত্মা উভয়ই ভোগ করবে। তাই দেহকে বাদ দিয়ে শুধু রূহের জন্য মাগফিরাত প্রার্থনার কোনো অর্থ হয় না। 

একটি ভুল ঘটনা : হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণের দিন কাবা শরীফে আযান শুরু
প্রচলিত আছে যে, হযরত ওমর রা. যেদিন ইসলাম গ্রহণ করেন, সেই দিন থেকে কাবাঘরে প্রথম আযান শুরু হয়।
রাহাতুল কুলুব জাতীয় কিছু বাজারী অনির্ভরযোগ্য বইয়েও এটিকে আরেকটু চটকদার করে উত্থাপন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যতদিন পর্যন্ত হযরত আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনে খাত্তাব রা. ইসলাম আনেননি ততদিন পর্যন্ত নামাযের আযান গুহায় গহবরে দেওয়া হত। কিন্তু যেদিন হযরত আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর ফারুক রা. ঈমান আনলেন সেদিন তিনি তলোয়ারমুক্ত করে দাঁড়িয়ে হযরত বেলাল রা.কে বললেন, কাবাঘরের মিম্বরে উঠে আযান দাও। হযরত বেলাল রা. তাঁর নির্দেশমতো কাজ করলেন।
বহুল প্রচলিত হলেও এই ঘটনাটি ভুল। কারণ বিশুদ্ধ রেওয়ায়েত ও নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সূত্র মতে, আযানের আদেশ এসেছিল মদীনায়, নবীজীর হিজরতের পর। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬০৪; ফাতহুল বারী ২/৯৩-৯৪)
অথচ হযরত ওমর রা. ইসলাম গ্রহণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল মক্কায়, ইসলামের প্রাথমিক যুগে। অতএব তাঁর ইসলাম গ্রহণের দিন কাবা শরীফে আযান শুরুর কথা অযৌক্তিক।
তবে এই কথা সত্য, হযরত ওমর রা. ইসলাম কবুলের পর ইসলামের শান-শওকত অনেক বুলন্দ হয়। ইসলামের প্রকাশ্য কার্যক্রম শুরু হয়। হযরত ইবনে মাসউদ রা. বলেন, আমরা ওমরের ইসলাম গ্রহণের ফলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি। আমরা পূর্বে কাবা শরীফে নামায আদায় করতে পারতাম না। যখন ওমর ইসলাম কবুল করলেন তাদের সাথে যুদ্ধ করলেন, ফলে তারা আমাদেরকে বাইতুল্লাহয় নামায পড়তে দিতে বাধ্য হল। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৬৮৪; ফাতহুল বারী ৭/৫৯; তবাকাতে ইবনে সাদ ৩/২৭০)
হয়ত বাইতুল্লায় প্রকাশ্য নামায আদায়ের রেওয়ায়েতটিকেই ভুলভাবে উপস্থাপন করে আযান দেওয়ার শব্দে বলা হয়েছে। অথচ সহীহ রেওয়ায়েতে আযানের কোনো উল্লেখ নেই।

দুটি ভুল ধারণা ক) খাওয়ার পর বরতন ধুয়ে খাওয়া কি সুন্নত?
কেউ কেউ মনে করে যে, খাওয়ার পর বরতন ধোয়া পানি পান করা সুন্নত। এই ধারণা সঠিক নয়। হাদীস ও সুন্নাহর কিতাবে এমন কোনো সুন্নতের কথা নেই। সুন্নত হল, খাওয়ার পর হাত, হাতের আঙ্গুল চেটে খাওয়া এবং বরতন ভালোভাবে মুছে খাওয়া। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে আঙ্গুল ও বরতন ভালোভাবে পরিষ্কার করে খাওয়ার আদেশ করেছেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২০২২)
সুতরাং আঙ্গুল ও প্লেট ভালোভাবে পরিষ্কার করে খাওয়া সুন্নত, ধুয়ে পানি পান করা সুন্নত নয়। তবে সুন্নত ও মুস্তাহাব মনে না করে কেউ যদি প্লেট ধুয়ে পানি পান করে তাহলে এতে কোনো অসুবিধা নেই; বরং তা মুবাহ। কিন্তু একে সুন্নত বলা সঠিক নয়।
খ) খাওয়ার পর মুখমন্ডলে ও পায়ের তালুতে হাত মোছা কি সুন্নত?
কোনো মজলিসে দেখলাম, এক ব্যক্তি খাবারের পর অতি গুরুত্বের সাথে পায়ের তালুতে হাত মুছলেন এবং সঙ্গীকেও সুন্নত বলে এতে উৎসাহিত করলেন।
আসলে এটিও সুন্নত নয়। একে সুন্নত বলা ভুল; বরং চর্বিযুক্ত খাবারের ক্ষেত্রে হাত সাবান বা গরম পানি দ্বারা উত্তমভাবে পরিষ্কার করে রুমাল বা তোয়ালে জাতীয় কিছুতে মুছে নেওয়া উচিত। হাদীসে আছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যখন আহার করে, তখন সে যেন আঙ্গুল চেটে খাওয়ার আগে রুমালে হাত না মোছে। (মুসনাদে আহমদ ১/৩৪৬, হাদীস : ৩২৩৪)
যাই হোক, খাওয়ার পর পায়ের তালুতে হাত মোছা বা বরতন ধুয়ে পানি পান করা না-জায়েয নয়, কিন্তু একে সুন্নত বলা ভুল। কোনো কাজ বৈধ হওয়া আর সুন্নত হওয়া এক কথা নয়। 

এটি হাদীস নয় : মেরাজে নবীজীর সাতাশ বছর সময় লেগেছিল
মেরাজ সম্পর্কে এক ওয়ায়েজকে বলতে শুনেছি যে, তাতে নাকি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাতাশ বছর সময় ব্যয় হয়েছিল। আরেক ওয়ায়েজ এই কথাটি বললেন আরো চটকদার করে। তার ভাষায়, ইন্তেকালের সময় যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জিবরীল ও মালাকুল মাওত হাজির হল, তখন তিনি মালাকুল মাওতকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এত তাড়াতাড়ি কেন এলে? আল্লাহ তো আমাকে নববই বছর হায়াত দিয়েছিলেন। তখন জিবরীল বললেন, আপনার জীবনের সাতাশ বছর তো মেরাজের রাতেই অতিবাহিত হয়ে গেছে!
উপরোক্ত বর্ণনার কোনো ভিত্তি আমরা পাইনি। মেরাজের সহীহ ও নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েতগুলোর কোথাও বলা হয়নি যে, মেরাজে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কত সময় অতিবাহিত হয়েছিল। কুরআন মজীদ এবং সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসে বলা হয়েছে যে, এই ঘটনাটি একটি রাতে সংঘটিত হয়েছিল। তাতে পুরো রাত লেগেছিল নাকি রাতের কিছু অংশ, না চোখের পলকেই ঘটে গিয়েছিল তা সহীহ হাদীসে নেই। হাদীসে এই কথাও নেই যে, আল্লাহ তাআলা তখন সময় ও সৃষ্টিজগতকে স্থির রেখেছিলেন কি না। 
অতএব মিরাজের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং তার রহস্য ও তাৎপর্য আলোচনার সময় এই সব অমূলক কথাবার্তার আশ্রয় নেওয়া খুবই নিন্দনীয় ও সর্বোতভাবে পরিত্যাজ্য।  কোনো দায়িত্বশীল ও আমানতদার ব্যক্তি এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। আল্লাহ তাআলার পরিষ্কার আদেশ- 
ولا تقف ما ليس لك به علم
 যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই এর পিছনে পড়ো না। এরপরও শুধু অনুমান ও ধারণার উপর ভিত্তি করে বলা, বিশেষত মানুষের সামনে বর্ণনা করা বড়ই অন্যায়। উপরন্তু তা যখন হয় আল্লাহ ও রাসূলের সাথে সম্পর্কিত তখন তো এর ভয়াবহতা বলার অপেক্ষা রাখে না। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন। আমীন।

এটি হাদীস নয় : আবু বকর রা.-এর কাছে জিবরীল আ. কি নিজের সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন
একটি ঘটনা সম্পর্কে কিছুদিন আগে এক ভাই ফোনে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। একই ঘটনা সম্পর্কে আজ একজন সরাসরি প্রশ্ন করলেন। ঘটনাটি হল, একবার আবু বকর রা. চট পরিধান করেন। হয়ত অভাবের কারণে কিংবা সাধনা-মুজাহাদার জন্য। তখন জিবরীল আ. মানুষের আকৃতিতে তার নিকট এসে জিজ্ঞাসা করলেন, বলুন তো জিবরীল এখন কোথায় আছেন।
সিদ্দীকে আকবর রা. মুরাকাবার মাধ্যমে জিবরীল আ.কে খুঁজতে লাগলেন। আসমান-যমীনে কোথাও না পেয়ে তিনি বললেন, আপনিই জিবরীল! তখন তিনি বললেন, আমি আপনাকে এই পয়গাম শোনাতে এসেছি যে, আপনার এই আমল এত মাকবুল হয়েছে, আপনার অনুকরণে আজ সকল ফেরেশতা চট পরিধান করেছে!! (নাউযুবিল্লাহ)
মনে রাখবেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা হাদীস, সীরাত ও ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য ও প্রসিদ্ধ কোনো কিতাবে আমরা পাইনি। আর আমাদের জানা মতে তাসাওউফের নির্ভরযোগ্য ও সনদযুক্ত কোনো কিতাবেও তা সহীহ সনদে পাওয়া যায় না। আল্লাহ তাআলা যাদেরকে রেওয়াত যাচাই-বাছাইয়ের যোগ্যতা ও রুচি দান করেছেন তারা শোনামাত্র বুঝবেন, এই ঘটনা সম্পূর্ণ বানোয়াট।
আল্লাহ তাআলা মিথ্যুকদের বিনাশ করুন। তারা সিদ্দীকে আকবরকেও রেহাই দেয়নি। নবীকেও না, এমনকি আল্লাহকেও ছাড়েনি। প্রত্যেকের সম্পর্কেই তারা মিথ্যাচার করেছে।

একটি ভিত্তিহীন ধারণা : দাফনের পর জুমআ বা রমযান এলে কি কিয়ামত পর্যন্ত আযাব মাফ হয়ে যায়
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কবরের আযাব থেকে রক্ষা করুন। আল্লাহ সকল মুমিন নর-নারীকে ক্ষমা করুন, সকলকে বরযখের আযাব থেকে মুক্তি দান করুন, আখিরাতের সকল মঞ্জিল সহজ ও নিরাপদে পার করিয়ে দিন।
কবরের আযাব সত্য। কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এই আযাব থেকে মুক্তির প্রথম শর্ত ঈমান। দ্বিতীয় শর্ত ঈমানের দাবি অনুযায়ী জীবন যাপন, বিশেষত যেসব গুনাহর কারণে কবরে আযাবের কথা বর্ণিত হয়েছে তা থেকে সর্বোতভাবে বেঁচে থাকা এবং যেসব আমলের দ্বারা কবরের আযাব থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি বর্ণিত হয়েছে সেসব আমল গুরুত্বসহকারে করা।
এখানে আমি যে কথাটি বলতে চাচ্ছি তা এই যে, কাউকে বলতে শোনা যায়, কৃত গুনাহর কারণে যার কবরে আযাব হওয়ার কথা তার দাফনের পর যখনই কোনো জুমআ বা রমযান আসে তখন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত তার আযাব বন্ধ হয়ে যায়।
অনেকে এ কথার পক্ষে আহসানুল ফাতাওয়ার উদ্ধৃতিও দিয়ে থাকেন।
বাস্তবে এ ধারণা ভিত্তিহীনএ ধরনের কথা কোনো সহীহ হাদীস বা শরীয়তের কোনো দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। আহসানুল ফাতাওয়ায় (৪/২০৮) যদিও এমন কথা আছে, কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়ার তাতিম্মা (পরিশিষ্ট) অর্থাৎ আহসানুল ফাতাওয়ার দশম খন্ডে (পৃষ্ঠা : ৪৩৩-৪৩৫)-এ দলিল-প্রমাণসহ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবং আগের কথাটিকে ভিত্তিহীন বলা হয়েছে।
সুতরাং এই ভিত্তিহীন কথা বিশ্বাস করা ও বলা থেকে বিরত থাকা উচিত। আর কবর ও আখিরাতকে সর্বোচ্চ সুন্দর বানানোর চেষ্টায় সর্বদা নিয়োজিত থাকা উচিত। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন। 

একটি ভুল রীতি : খতম কি বখশানো জরুরি?
ইতিপূর্বে লিখেছি কিনা মনে নেই। আমি গ্রামে দেখেছি এবং কেউ কেউ ফোন করেও জানিয়েছেন যে, সাধারণত মেয়েদের মাঝে এই রেওয়াজ আছে যে, রমযানে তাঁদের খতম সমাপ্ত হওয়ার পর মসজিদের ইমাম সাহেবকে তা জানানোর ইহতিমাম করা হয় যে, অমুক কুরআন খতম করেছে, তা বখশে দিন! কোথাও কোথাও এ কথা জানানোর সাথে সাথে বখশানেওয়ালার জন্য কিছু হাদিয়া পাঠানোরও রেওয়াজ আছে।
এই রেওয়াজের মধ্যে এমন অনেক বিষয় আছে, যা বর্জনীয়। যেমন
ক. কুরআন খতম করা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ-ইবাদত। কেউ খতম করলে এটা জরুরি নয় বা এমন কোনো বিধান নেই যে, তা বখশাতেই হবে। হ্যাঁ, কেউ কোনো নেক আমল করে মৃত মুসলিমদের জন্য ছওয়াব রেসানী করতে চাইলে তার অনুমতি আছে। কিন্তু না এটা কুরআন-খতমের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ, না রমযান মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাছাড়া একটি মোবাহ কাজকে জরুরি কাজের মতো গুরুত্ব দেওয়াও সমীচীন নয়।
খ. ছওয়াব রেসানীর জন্য আমলের আগে বা পরে এই নিয়তই যথেষ্ট যে, আমলটি অমুকের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। তদ্রূপ অন্তরের এই দুআই যথেষ্ট যে, আয় আল্লাহ! এই আমলের ছওয়াব অমুক অমুককে দান করুন বা সকল মৃত মুসলমানকে দান করুন। ছওয়াব রেসানীর জন্য এ-ই যথেষ্ট। ইমাম সাহেব, বা কোনো বুযুর্গের মাধ্যমে বখশানোর কোনো প্রয়োজন নেই। কোনো বুযুর্গের দ্বারা বখশানো ছাড়া ছওয়াব পৌঁছবে না এমন ধরণা একটি ভুল আকীদা, যা ত্যাগ করা জরুরি।
গ. বখশানোর জন্য হাদিয়া দেওয়া বা নেওয়ার বিষয়টিও বর্জনীয়। আমল বখশানো অর্থ দুআ করা। আর দুআ একটি খালিস ইবাদত, যার বিনিময়ে হাদিয়ার আদান-প্রদান জায়েয নয়।
এছাড়া এভাবে ইমাম সাহেবের দ্বারা আমল বখশানোর রীতির কারণে মেয়েদের নাম এবং তাদের খতম বা খতমের সংখ্যা ইত্যাদি গোপন বিষয় মানুষের সামনে আসে। কোনো প্রয়োজন ছাড়া এমনটি করার কী যুক্তি? তো সব বিচারেই এই রসম বর্জনীয়। (http://www.alkawsar.com/article/722)

একটি ভুল ধারণা : যাকাত কি শুধু রমযান মাসে আদায় করতে হয়?
অনেক মানুষ মনে করে যে, যাকাত শুধু রমযান মাসে আদায়যোগ্য আমল। এ ধারণা ঠিক নয়। নিসাব পরিমাণ সম্পদের উপর এক চান্দ্র বছর অতিবাহিত হলেই সেই সম্পদের যাকাত দেওয়া ফরয। যাকাত ফরয হওয়ার পর দ্রুত আদায় করতে হবে। কিন্তু কোনো কোনো লোককে দেখা যায়, তাদের যাকাতবর্ষ রমযান মাসের আগে, এমনকি ৪/৫ মাস আগে হয়ে যায়। এরপরও তারা তখন যাকাত আদায় করে না; বরং রমযানের অপেক্ষা করতে থাকে। এমন করা আদৌ উচিত নয়। বরং গরীবের পাওনা যত দ্রুত আদায় করা যায় ততই শ্রেয়। হ্যাঁ, যাদের যাকাতবর্ষ রমযান মাসে পূর্ণ হয় তারা রমযানেই আদায় করবেন। 

একটি ভুল ধারণা : জায়নামায বিছিয়ে রাখলে কি শয়তান এসে তাতে নামায পড়ে নেয়?
অনেকের ধারণা, নামায পড়ার পর জায়নামায বিছিয়ে রাখলে শয়তান এসে তাতে নামায পড়ে নেয়। এটি একটি ভুল ধারণা। তবে নামায পড়া হয়ে গেলে জায়নামায বিছিয়ে না রাখাই ভাল। কারণ জায়নামায পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র রাখা জরুরী। বিছিয়ে রাখলে তার উপর দিয়ে চলাফেরা হবে। ফলে তা ময়লা হবে। কখনো নাপাকীও লেগে যেতে পারে।
উল্লেখ্য, কিতাব বা কুরআন শরীফের ব্যাপারেও অনেককে এমন ধারণা পোষণ করতে দেখা যায় যে, খুলে রাখলে শয়তান এসে  পড়ে নিবে। এ ধারণাও ঠিক নয়। তবে পড়ার পর প্রয়োজন ছাড়া খুলে না রাখাই ভালো।

একটি অমার্জিত আচরণ : মাইক টেস্টের জন্য কুরআন তিলাওয়াত করা
অনেক সময় মাইক টেস্টের জন্য  কুরআন তিলাওয়াত করতে দেখা যায়এটা ঠিক নয়। কুরআন তিলাওয়াত একটি ইবাদাতে মাকছুদাহ ও স্বতন্ত্র ইবাদাত। হাদীস শরীফে কুরআন তিলাওয়াতের বহু ফযীলত  বর্ণিত হয়েছে। আর কুরআন হল আল্লাহ্র কালাম, যা সর্বোচ্চ তাযীমের বিষয়। সুতরাং কুরআন তিলাওয়াতকে মাইক টেস্ট ইত্যাদি কাজের মাধ্যম বানানো কখনোই সমীচীন নয়। এটা কালামুল্লাহ্র তাযীমের খেলাফ। অনুরূপভাবে মোবাইলের রিংটোনের জন্যও কুরআন তিলাওয়াতের ব্যবহার অনুচিত। কারণ মোবাইল নিয়ে টয়লেটে প্রবেশের পর কল এলে অপবিত্র স্থানে আল্লাহ তাআলার পবিত্র কালামের ধ্বনি বেজে ওঠে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আল্লাহ সকলকে দ্বীনের সহীহ সমঝ দান করুন।

এটি হাদীস নয় : আপনার জুতায় আরশ ধন্য হয়েছে
লোকমুখে মেরাজ সম্পর্কে একটি কথা প্রসিদ্ধ আছে যে, মেরাজ রজনীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরশে মুআল্লায় প্রবেশের পূর্বে জুতা খুলতে চাইলে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
يا محمد! لا تخلع نعليك، فإن العرش يتشرف بقدومك متنعلا ويفتخر على غيره متبركا.
হে মুহাম্মাদ! আপনি জুতা খুলবেন না। (জুতা নিয়েই আরোহন করুন) কেননা, আপনার জুতা নিয়ে আগমনে আরশ ধন্য হবে। এটি বরকত লাভের কারণে অন্যের উপর গর্ববোধ করবে।
কথাগুলো সাধারণ মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধ তো আছেই, কোন কোন বক্তার মুখেও শোনা যায়। কিন্তু তা প্রমাণিত নয়। সবগুলোই মনগড়া ও বানানো কথা।
ইমাম রযীউদ্দীন আল-কায্ভীনী (রহ.)কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জুতা নিয়ে আরশ গমন এবং আল্লাহ তাআলার সম্বোধন (হে মুহাম্মাদ! আপনার জুতায় আরশ ধন্য হয়েছে) ইত্যাদি প্রমাণিত কি না। তিনি উত্তরে বলেছিলেন-
أما حديث وطئ النبي صلى الله عليه وسلم العرش بنعله فليس بصحيح ولا ثابت، بل وصوله إلى ذروة العرش لم يثبت في خبر صحيح ولا حسن ولا ثابت أصلا، إنما صح في الأخبار انتهاؤه إلى سدرة المنتهى فحسب.
জুতা পায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আরশ গমনের হাদীস প্রমাণিত নয়। এমনকিক তিনি (খালি পায়ে) আরশে পৌঁছেছেন এমন কথাও কোন নির্ভরযোগ্যসূত্রে বর্ণিত নেই। সহীহ বর্ণনা মতে তিনি শুধু সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গমন করেছেন।-সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ-শরহুল মাওয়াহেব ৮/২২৩
অপর এক মুহাদ্দিসের ভাষ্য-
আল্লাহ তাআলা তাকে ধ্বংস করুন, যে বলে তিনি জুতা নিয়ে আরশে আরোহণ করেছেন। কত ঔদ্ধত্য! কত বড় স্পর্ধা!! যিনি শিষ্টাচারীদের সরদার, যিনি আরেফবিল্লাহগণের মধ্যমণি, তাঁর ব্যাপারে এমন কথা! তিনি আরো বলেন যে, রযীউদ্দীন আল-কাযভীনীর উত্তরই সঠিক। প্রায় চল্লিশজন সাহাবী থেকে সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিতভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মেরাজ তথা উর্ধ্ব জগতে গমনের ঘটনা বর্ণিত আছে। এঁদের কারো হাদীসে এ কথা উল্লেখ নেই যে, সে রাতে তাঁর পায়ে জুতা ছিল। এ কথা কতক গন্ডমূর্খ কিসসা-কাহিনীকারদের কাব্যে এসেছে। ... কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হাদীসে বা দুর্বলসূত্রে বর্ণিত হাদীসেও এ কথা নেই যে, তিনি আরশে আরোহন করেছেন। এটি কারো বানানো কথা, এর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা যায় না।-শরহুল মাওয়াহেব ৮/২২৩
আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ মাক্কারী (রহ.) স্বরচিত গ্রন্থ ফাতহুল মুতাআল ফী মাদহি খাইরিন নিআল-এ উপরোক্ত কথাটিকে জাল বলে জানিয়েছেন।-আল আসারুল মারফুআ ৩৭
আরো দ্রষ্টব্য : গায়াতুল মাকাল ফীমা ইয়াতাআল্লাকু বিন্নিআল : আল্লামা লাখনোভী (রহ.)
(http://www.alkawsar.com/article/870)

একটি ভুল ধারণা : গোঁফ স্পর্শ করা পানি পান করা কি হারাম?
অনেক মানুষের ধারণা, পান করার সময় যদি পানি গোঁফ স্পর্শ করে তাহলে সেই পানি পান করা হারাম হয়ে যায়। এ ধারণা ঠিক নয়। হাঁ, হাদীস শরীফে দাড়ি লম্বা করতে বলা হয়েছে আর গোঁফ খাটো করতে বলা হয়েছে। তাই দাড়ি মুন্ডানো বা খাটো করা গুনাহ এবং মোচ বড় করে রাখা না-জায়েয।
(http://www.alkawsar.com/article/872)

আরেকটি ভিত্তিহীন কথা : কিয়ামতের দিন কি নবীজী তিন স্থানে বেহুশ হবেন? (নাউযুবিল্লাহ)
মীযান, আমলনামা ও পুলসিরাতের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে কাউকে বলতে শোনা গেছে, এই তিন স্থানে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে যে, নবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত এই তিন স্থানে বেহুশ হয়ে যাবেন (নাউযুবিল্লাহ)।
কথার কোনোই ভিত্তি নেই। এ ধরণের কথা বলা মারাত্নক গুনাহের কাজ। বরং হাদীস শরীফে তো এসেছে, হযরত আনাস রা. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিয়ামতের দিন আমার জন্য সুপারিশের  আবেদন জানালাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (হ্যাঁ) আমি তোমার জন্য সুপারিশ করব। আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল! আমি (সেদিন) আপনাকে কোথায় খুঁজব। নবীজী বললেন, প্রথমে (পুল)সিরাতের কাছে খুঁজবে।  বললাম, সেখানে যদি আপনার সাথে আমার সাক্ষাৎ না হয় তাহলে কোথায় খুঁজব? তিনি বললেন, তাহলে আমাকে মীযানের কাছে খুঁজবে। আমি বললাম, সেখানেও যদি আপনাকে না পাই? নবীজী বললেন, তাহলে হাউজের (হাউজে কাউসার) কাছে খুঁজবে। কারণ আমি সেদিন এই তিন স্থানের কোনো না কোনো স্থানে থাকবই।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৪৩৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ১২৮২৫
এর চেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেহুশ হবেন না। হাশরের ময়দানে যখন আল্লাহ তাআলা কঠিন ক্রোধের অবস্থায় থাকবেন। মানুষ সুপারিশের জন্য বড় বড় নবীগণের কাছে যাবে, সকলে অপারগতা প্রকাশ করবেন। অবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলে তিনি সুপারিশ করবেন (বিস্তারিত: জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৪৩৪; সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৩৪০)
হ্যাঁ, একথা ঠিক যে, এ সকল স্থানে বান্দাদের অবস্থা অনেক নাজুক ও ভয়াবহ হবে। কিন্তু এ তিন স্থানে নবীজী বেহুশ হয়ে যাবেন এ কথা একেবারেই অবাস্তব।
আল্লাহ তাআলা আমাদের মনগড়া কথা বলা থেকে হেফাজত করুন। (http://www.alkawsar.com/article/894)
একটি ভুল ঘটনা : হযরত আবু বকর রা.-এর চট পরিধান করা
অনেক বক্তাকেই এই চটকদার কাহিনী বলতে শোনা যায়। একবার হযরত আবু বকর রা. আল্লাহর রাস্তায় দান করতে করতে সবকিছু দান করে দিলেন। এমনকি তিনি নিজের গায়ের পোশাকও দান করে দিলেন। এখন তিনি সতর ঢাকার জন্য ছালার চট পরিধান করলেন। হযরত আবু বকরের এই কাজ আল্লাহ এত পছন্দ করলেন যে, সমস্ত ফেরেশতাকে ডেকে বললেন, আমার হাবীবের দোস্ত আবু বকর নিজের সবকিছু দান করে চট পরিধান করেছে। সুতরাং তোমরাও তার অনুসরণে চট পরিধান কর। সমস্ত ফেরেশতা তখন দীর্ঘ তিনদিন পর্যন্ত চট পরিধান করে ছিলেন।’’
আল্লাহর রাস্তায় দান করার ফযীলত বা আবু বকর রা.-এর ফযীলত হিসেবে অনেকে ঘটনাটি বলে থাকেন। কিন্তু আসলে এটি একটি জাল বর্ণনা যা উশনানী নামক জনৈক মিথ্যাবাদী কর্তৃক জালকৃত।
ইবনুল জাওযী রাহ. তাঁর আলমাউযুআত কিতাবে (খ. ১ পৃ.৩১৪) বলেন, এটা উশনানীর জালকৃত বর্ণনা।
সুয়ূতী রাহ. আললাআলিল মাছনূআ-তে (১ : ২৬৯) বলেন, এটি একটি জাল বর্ণনা যা উশনানী কর্তৃক জালকৃত।
এছাড়া দেখুন, আলফাওয়াইদুল মাজমূআ ১:৩৩২; তানযীহুশ শারীআহ ১:৩৯১
তার জালকৃত বর্ননা নিম্নরূপ :
জিবরীল আ. একবার চট পরিহিত অবস্থায় নবীজীর কাছে আগমন করলেন। নবীজী বললেন, হে জিবরীল! আপনাকে তো এমন পোশাকে কখনো দেখিনি? উত্তরে জিবরীল আ. বললেন, আল্লাহ তাআলা আসমানে সকল ফেরেশতাকে এই পোশাক পরতে নির্দেশ করেছেন। কারণ আবু বকর যমীনে এই পোশাক পরেছে।’’ এই হল তার জালকৃত বর্ণনা। কিন্তু কাহিনীকাররা এর সাথে আগে পরে আরো কথা যোগ করে আরো চটকদাররূপে বর্ণনা করে। আর আবু বকর রা.-এর ফযীলত বা তাঁর দান করার ঘটনা তো সহীহ হাদীসেই বর্ণিত হয়েছে। সেগুলো বলা উচিত।
হাদীস শরীফে এসেছে, ওমর রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দান করার নির্দেশ দিলেন। তখন আমার হাতে বেশ সম্পদও ছিল। আমি মনে মনে বললাম, আজ আমি আবু বকরের চেয়ে অগ্রগামী হব। আমি আমার অর্ধেক সম্পদ নবীজীর দরবারে পেশ করলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ (হে ওমর!)? আমি বললাম, অনুরূপ অর্ধেক রেখে এসেছি।
তারপর আবু বকর তাঁর সমস্ত সম্পদ নিয়ে হাজির হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু বকর! পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ? তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি। তখন আমি বললাম, আল্লাহর কসম, আমি কখনোই তাঁর চেয়ে অগ্রগামী হতে পারব না। (জামে তিরমিযী, হাদীস:৩৬৭৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস:১৬৮০; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস:১৫১০) 

একটি ভিত্তিহীন ঘটনা : ওয়ায়েস করনীর দাঁত ভাঙার গল্প
ওয়ায়েস করনীর দাঁত ভাঙার গল্প লোকমুখে খুবই প্রসিদ্ধ। ঘটনাটি নিমণরূপ- ওহুদ যুদ্ধে যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানদান মোবারক শহীদ হল তখন ওয়ায়েস করনী বিষয়টি জানতে পারলেন এবং যারপরনাই ব্যাথিত হলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা ছিল। এ ঘটনা শুনে তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি ভাবলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাঁত মোবারক যখন শহীদ হয়েছে তো আমার এ দাঁতের কী অর্থ! তিনি নিজের একটি দাঁত ভেঙে ফেললেন। পরক্ষণে চিন্তা করলেন, আমি যে দাঁত ভেঙেছি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হয়ত এ দাঁত ভাঙেনি অন্য দাঁত। তাই ভেবে তিনি নিজের আরেকটি দাঁত ভেঙে ফেললেন। এভাবে তিনি নিজের সবগুলো দাঁত ভেঙে ফেললেন।
নবীজীর প্রতি উম্মতের ভালবাসা প্রকাশের চূড়ান্ত নযীর হিসেবে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে এ ঘটনা বলে থাকেন। কিন্তু এ ঘটনার কোনোই ভিত্তি নেই। মোল্লা আলী কারী রাহ. বলেন, এ ঘটনা প্রমাণিত নয়। (দ্র. আলমাদিনুল আদানী, আলবুরহানুল জালি ফী তাহকীকি ইনতিসাবিস সুফিয়্যাতি ইলা আলী, পৃ. ১৬৪-১৬৫) ওয়ায়েস  করনী (উয়াইস আলকারানী) একজন বড় মাপের তাবেয়ী ও বুযুর্গ ছিলেন। ইয়ামানের অধিবাসী ছিলেন। তিনি ৩৭ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ তার হয়নি। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা ছিল। তার বৃদ্ধা মা ছিলেন। মায়ের সাথে তিনি সদাচরণ করতেন। মায়ের সেবাযত্ন করতেননবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে চিনতেন। হাদীস শরীফে এসেছে, ওমর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইয়ামান থেকে উয়াইস নামে এক ব্যক্তি তোমাদের কাছে আসবে। ইয়ামানে মা ছাড়া তার আর কেউ নেই। তার শ্বেত রোগ ছিল । সে আল্লাহর কাছে দুআ করলে আল্লাহ তার রোগ ভাল করে দেন, কিন্তু তার শরীরের একটি স্থানে এক দিনার অথবা এক দিরহাম পরিমাণ স্থান সাদাই থেকে যায়। তোমাদের কেউ যদি তার সাক্ষাৎ পায় সে যেন তাকে নিজের জন্য ইস্তেগফার করতে বলে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৪২
ওয়ায়েস করনীর সাথে সাহাবীদের সাক্ষাতের ঘটনাও হাদীস শরীফে এসেছে। কিন্তু কোথাও এমন কিচ্ছার কথা নেই। সহীহ মুসলিমে এসেছে, ওমর রা.-এর সাথে ওয়ায়েস করনীর সাক্ষাত হলে তাকে সনাক্ত করার জন্য তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের  বলে দেয়া সব আলামত জিজ্ঞাসা করেন। এ বর্ণনায় আছে ওমর রা. নবীজীর কথা অনুযায়ী তাকে নিজের জন্য ইস্তিগফার করতে বলেন, তিনি ওমর রা.-এর জন্য ইস্তিগফার করেন। পরবর্তী বছর হজ্বের মৌসুমে ওয়ায়েস করনী যে এলাকায় বসবাস করছিলেন সেখান থেকে এক ব্যক্তি এলে ওমর রা. তার (ওয়ায়েস করনীর) খোঁজ খবর নেন। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৪২)

একটি বাতিল বর্ণনা : আল্লাহ সুস্থতার নিআমত চাইতেন (নাউযুবিল্লাহ)
মূসা আ. ও আল্লাহর মাঝে কথোপকথন হয়েছে এটা কুরআন দ্বারা স্বীকৃত। এজন্য মূসা আ.-কে মূসা কালিমুল্লাহ বলা হয়। এটাকেই পুঁজি করে এক শ্রেণীর কাহিনীকার মূসা আ. ও আল্লাহর মাঝে কথোপকথন শিরোনামে সমাজে বহু আজগুবি ঘটনা বলে থাকে, যা ওয়াজের মাঠ গরম করে ঠিকই কিন্তু সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই।
এগুলোর মধ্যে প্রসিদ্ধ একটি কথোপকথন হল সুস্থতার নিআমত বিষয়ে। ‘‘মূসা আ. আল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ! আপনি যদি মূসা হতেন আর আমি যদি আল্লাহ হতাম তাহলে আপনি কী চাইতেন? আল্লাহ বললেন, এটা আমার শান না। মূসা বললেন, তা তো জানি, কিন্তু হলে কী চাইতেন। তখন আল্লাহ বলেন, সুস্থতা চাইতাম।’’
সুস্থতা কত বড় নিআমত একথা বোঝাতে এই বানোয়াট কিচ্ছা বলা হয়, যার সাথে মূসা আ.-এর কোনোই সম্পর্ক নেই।
এমন কথোপকথনের অর্থ দাঁড়ায় মূসা আ. আল্লাহর সাথে মশকরা করছেন। (নাউযুবিল্লাহ) যা একজন নবীর জন্য কখনোই শোভন নয়। একজন নবীর শানে এধরনের কথা বলা বড়ই বেআদবী ও গর্হিত কাজ, যা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
সুস্থতার নিআমতের ব্যাপারে তো হাদীস শরীফে কত সুন্দর সুন্দর কথা এসেছে সেগুলোই বলা উচিত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ: الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ
 ‘‘দুটি নিআমতের ব্যাপারে মানুষ বড়ই ক্ষতির মধ্যে (লসের মধ্যে) রয়েছে। একটি হল, সুস্থতা, অপরটি হল, অবসর। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪১২)
সুস্থতা ও অবসরকে মানুষ যথাযথ কাজে লাগায় না। যখন অসুস্থ হয় বা ব্যস্ততা বেড়ে যায় তখন বলে, এখন আমি সুস্থ থাকলে বা আমার অবসর থাকলে অমুক ভাল কাজ করতাম। অথবা বলে, সুস্থ হলে বা অবসর পেলে অমুক ভাল কাজ করব। অথচ আগের সুস্থতার সময় বা অবসর সময়কে সে হেলায় নষ্ট করেছে। এদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে হাদীস শরীফে।
সুতরাং সহীহ বর্ণনা থাকতে ভিত্তিহীন কথা বলা মূর্খতা বৈ কিছুই নয়। আমরা তা থেকে বিরত থাকব এবং যাচাই বাছাই ছাড়া কিছু বলব না এবং কোনো কিছু শোনামাত্রই বলে বেড়াব না। 

একটি ভুল ধারণা : শুকরের নাম মুখে নিলে কি চল্লিশদিন মুখ নাপাক থাকে?
অনেক মানুষকে বলতে শোনা যায়, শুকর-এর নাম উচ্চারণ করলে চল্লিশদিন মুখ নাপাক থাকে; শুকুর না বলে খিনযীর বলতে হবে। একথাটি একেবারেই অমূলক।
শুকরকে আল্লাহ তাআলা হারাম করেছেন, আর হারাম বস্তুর প্রতি ঘৃণা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে শুকরের নাম মুখে উচ্চারণ করলেও মুখ নাপাক হয়ে যাবে -একথার কোনো ভিত্তি নেই।
এরপর শুকর বাংলা শব্দ, এর আরবী হল খিনযীর। একই প্রাণীর নাম বাংলায় উচ্চারণ করলে মুখ নাপাক হবে আর আরবীতে উচ্চারণ করলে নাপাক হবে না এরই বা কী অর্থ? আল্লাহ আমাদের অমূলক কথা বলা থেকে হেফাযত করুন।

একটি ভিত্তিহীন ঘটনা : হাসান বসরীর পানির উপর জায়নামায বিছিয়ে নামায পড়া এবং রাবেয়া বসরীর শূন্যের উপর জায়নামায বিছিয়ে নামায পড়া
রাবেয়া বসরী (হবে রাবেয়া বসরিয়্যাহ্) দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন প্রসিদ্ধ আবেদা নারী ছিলেন। ইমাম যাহাবী রাহ.-এর সিয়ারু আলামিন নুবালা, ইবনে খাল্লিকান রাহ.-এর অফাইয়াতুল আইয়ান, শারানী রাহ.-এর আততাবাকাতুল কুবরাসহ আরো বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থে তাঁর জীবনী সন্নিবেশিত হয়েছে। তাঁর বিষয়ে সমাজে বিভিন্ন বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী প্রচলিত আছে।
তাঁর ও প্রসিদ্ধ তাবেয়ী হাসান বসরী রাহ.-এর বিষয়ে একটি কাহিনী অনেককে বলতে শোনা যায়-
            একবার হাসান বসরী রাহ. পানির উপর জায়নামায বিছিয়ে নামায পড়লেন। রাবেয়া বসরিয়্যাহ্ একথা জানতে পারলেন এবং তিনি শূন্যের উপর জায়নামায বিছিয়ে নামায পড়লেন। হাসান বসরী রাহ. যখন একথা জানতে পারলেন তখন বললেন, রাবেয়ার মাকাম আমার অনেক উপরে।
            এ কিচ্ছার কোনোই ভিত্তি নেই। এটি একেবারেই কল্পনাপ্রসূত একটি কাহিনী, বাস্তবতার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। নির্ভরযোগ্য কোনো ইতিহাসগ্রন্থ বা রাবেয়া বসরিয়্যাহ-এর উপর রচিত কোনো নির্ভরযোগ্য জীবনীগ্রন্থে এ ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় না।
            তাঁরা কত বড় বুযুর্গ ছিলেন একথা বুঝাতেই এজাতীয় কিচ্ছা-কাহিনীর অবতারণা করা হয়।
            তাঁরা অনেক বড় মাপের বুযুর্গ ছিলেন, একথা স্বীকৃত। তাঁরা যুহ্দ ও তাকওয়ায়, দুনিয়াবিমুখতা ও খোদাভীতিতে অনেক অগ্রগামী ছিলেন। কিন্তু এধরনের কাহিনী দিয়ে তাদের বুযুর্গি প্রমাণ করার কী দরকার হয়ে পড়ল? আর এসবের সাথে বুযুর্গিরই বা কী সম্পর্ক?
            আর আল্লাহর ওলীদের থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারামত প্রকাশিত হয় একথা স্বীকৃত। সাথে সাথে একথাও স্বীকৃত যে, কারামতের সাথে বুযুর্গির কোনো সম্পর্ক নেই। বুযুর্গি ও আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার মাপকাঠি হল, তাকওয়া তথা আল্লাহর ভয় ও সুন্নত অনুযায়ী জীবন যাপন করা।
            আর বানোয়াট এঘটনায় আরেকটি দিক দেখা যাচ্ছে। তা হল, একজন পানির উপর জায়নামায বিছিয়ে নামায পড়ছেন তা শুনে অপরজন শূন্যের উপর জায়নামায বিছিয়ে নামায পড়ছেন; যেন বুযুর্গির পাল্লা চলছে! আল্লাহওয়ালারা নিজেদেরকে আড়াল করতে চান। আর তাঁদের মত অনুসরণীয় বুযুর্গরা যেন নিজেদের বুযুর্গির প্রদর্শন করছেন। নাউযুবিল্লাহ। এটা তাদের ব্যাপারে মস্তবড় অপবাদও বটে!
            আরেকটি বিষয় হল, হাসান বসরী রাহ. ইন্তেকাল করেছেন ১১০ হিজরীতে। আর রাবেয়া বসরীর জন্মই হয়েছে ৯৯ অথবা ১০০ হিজরীতে। অর্থাৎ হাসান বসরী রাহ.-এর ইন্তেকালের সময় রাবেয়া বসরিয়্যাহ রাহ.-এর বয়স ছিল সর্বোচ্চ ১১/১২ বছর। সিয়ারু আলামিন নুবালায় (৮/২৪১) যাহাবী রাহ. বলেন, রাবেয়া বসরীয়্যাহ ১৮০ হিজরীতে ইন্তিকাল করেছেন। কথিত আছে, তিনি আশি বছর হায়াত পেয়েছেন। সুতরাং এ বিষয়টিও এঘটনার অসারতা প্রমাণ করে।

একটি ভিত্তিহীন কথা :একটি ভাতের দানা বানাতে সত্তরজন ফিরিশতা লাগে
খাদ্য পড়ে গেলে তুলে খেতে হয়- এটা সকলেরই জানা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদ্য পড়ে গেলে তুলে খেতে বলেছেন। এমনকি খাদ্যে ময়লা লেগে গেলে তা পরিষ্কার করে খেতে বলেছেন। নিজেও এর উপর আমল করা উচিত এবং অন্যকেও উৎসাহ দেওয়া উচিত। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা ভাত পড়ে গেলে তুলে খাওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে বলে, ভাত নষ্ট করতে নেই; একটি ভাতের দানা বানাতে সত্তরজন ফিরিশতা লাগে।
একথার কোনো ভিত্তি নেই। একটি ভাত বা চাল তৈরি হতে কতজন ফিরিশতা লাগে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। এটি অদৃশ্য জগতের বিষয়। তবে একটি ভাতের দানা আমার পর্যন্ত আসতে যে অনেক মানুষের শ্রম আছে এবং মাটি, পানি, চন্দ্র-সূর্য ইত্যাদিকে আল্লাহ তাআলা এ উদ্দেশ্যে ও এমন অনেক উদ্দেশ্যে আমাদের খেদমতে নিয়োজিত করেছেন তা কারই বা অজানা। সুতরাং একটি ভাতের দানা হোক বা যে কোনো খাদ্যদ্রব্য হোক, নষ্ট বা অপচয় করার কোনো অবকাশ নেই। এর জন্য আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে।
খাদ্য আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত। এর শুকরিয়া আদায় করা এবং অপচয় থেকে বিরত থাকা জরুরি। কখনো যেন এমন না হয় যে, আমি খাচ্ছি, কিন্তু না খাওয়ার শুরুতে আল্লাহর নাম নিলাম, না শেষে শুকরিয়া আদায় করলাম।

একটি ভুল কথা :শিক্ষক ছাত্রকে শরীরের যে স্থানে আঘাত করবে তা জান্নাতে যাবে!
কিছু মানুষকে বলতে শোনা যায়,পড়াতে গিয়ে বা তারবিয়াত করতে গিয়ে শিক্ষক যদি ছাত্রকে প্রহার করেন তাহলে শরীরের যে স্থানে প্রহার করা হয়েছে ঐ স্থান জান্নাতে যাবে বা জাহান্নামে যাবে না।
একথার কোনো ভিত্তি নেই। কাউকে শিক্ষক প্রহার করলে হয়ত সান্তনা দেওয়ার জন্য তার হিতাকাঙ্খী কেউ একথাটি বলে-শিক্ষক প্রহার করলে মন খারাপ করার কিছু নেই। কারণ,শিক্ষক ছাত্রকে শরীরের যে স্থানে আঘাত করবে তা জান্নাতে যাবে বা জাহান্নামে যাবে না।
উদ্দেশ্য ভালো হলেও এটি একটি ভিত্তিহীন কথা। তবে কোনো শিক্ষক যখন পড়ার কারণে বা আদব শিক্ষা দিতে গিয়ে ছাত্রকে প্রহার করেন এটা তিনি ছাত্রের ভালোর জন্যই করেন। সুতরাং ছাত্রের উচিত মাথা পেতে তা গ্রহণ করা। জিদ না করে যে কারণে তাকে প্রহার করা হয়েছে তা শুধরে নেওয়া।
তেমনি পিতা-মাতা, মুরব্বী যদি ছোটকে কখনো বিশেষ কারণে প্রহার করেন সেটাও তার ভালোর জন্যই করেন, নিজের ভালোর জন্যই তা মেনে নেওয়া উচিত।
এখন উস্তায বা পিতা-মাতা কতটুকু প্রহার করতে পারেন কিংবা কখন পারেন কখন পারেন না ইত্যাদি ভিন্ন আলোচনা। শরীয়তে এর মূলনীতি রয়েছে। ছাত্র বা সন্তানের এর পিছনে পড়া উচিত নয়। তার উচিত, মুরব্বীর সাথে বেআদবী না করা এবং যে কারণে তাকে প্রহার করা হয়েছে তা সংশোধন করা। 


একটি ভিত্তিহীন কাহিনী : মূসা আ. ও আল্লাহর মাঝে কথোপকথন
আপনার কথা বললে মজলিসে লোক কম হয় কেন?...
কিছু কিছু মানুষকে দ্বীনী মজলিসে বসতে পারার ফযীলত হিসেবে নীচের কাহিনীটি বলতে শোনা যায়-
মূসা আ. একবার আল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার আলোচনা করলে মানুষ কম হয় কেন?
আল্লাহ বললেন, এক তোড়া ফুল আনো। মূসা আ. বেছে বেছে সুন্দর সুন্দর ফুল দিয়ে একটি তোড়া বানিয়ে আনলেন।
আল্লাহ বললেন, এত ফুল থাকতে বেছে বেছে আনলে কেন?
মূসা আ. বললেন, বেছে বেছে সুন্দর দেখে পছন্দ করে এনেছি।
তখন আল্লাহ বললেন, আমিও আমার মজলিসে আমার বান্দাদের থেকে বেছে বেছে পছন্দনীয় বান্দাদের আনি।
যে উদ্দেশ্যেই বলা হোক এটি একটি ভিত্তিহীন কাহিনী। কোনো নির্ভরযোগ্য বর্ণনার মাধ্যমে তা প্রমাণিতও নয়। সুতরাং এটি বর্ণনা না করা চাই। দ্বীনী মাহফিল বিষয়ে যে সহীহ হাদীস রয়েছে সেগুলোই বর্ণনা করা উচিত।

একটি ভিত্তিহীন বর্ণনা
ফজরের নামায তরক করলে চেহারার জ্যোতি কমে যায়, যোহরের নামায তরক করলে...
যে ব্যক্তি ফজরের নামায তরক করে তার চেহারার জ্যোতি কমে যায়। যে ব্যক্তি যোহরের নামায তরক করে তার রিযিকের বরকত কমে যায়। যে ব্যক্তি আসরের নামায তরক করে তার শরীরের শক্তি কমে যায়। যে ব্যক্তি মাগরিবের নামায তরক করে তার সন্তানরা তার কোনো কাজে আসবে না। যে ব্যক্তি এশার নামায তরক করে তার ঘুমের শান্তি চলে যায়।
নামায তরক করার ক্ষতি হিসেবে অনেকে এ বর্ণনাটি পেশ করে থাকেন। এবং এটি লোকমুখে হাদীস হিসেবে খুব প্রসিদ্ধও বটে। কিন্তু বাস্তবে এটি নবীজীর হাদীস নয়; একটি ভিত্তিহীন বর্ণনা।
হাদীসের নির্ভরযোগ্য কোনো কিতাবে আমরা এর কোনো সূত্র পাইনি; সহীহ-যঈফ কোনো ধরনের সূত্রেই পাওয়া যায়নি। সুতরাং এটিকে হাদীস হিসেবে বর্ণনা করা যাবে না।
বেশ কিছু আয়াত-হাদীসে নামায তরক করার বিষয়ে সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে। নামায তরক করার ক্ষতি বা শাস্তি হিসেবে সেগুলোই বর্ণনা করা উচিত। এধরনের জাল বর্ণনা পরিহার করা উচিত।
এ বিষয়ক কয়েকটি আয়াত ও সহীহ হাদীস নিচে উল্লেখ করা হল-
সূরা মারইয়ামের ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلَاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا.
তারপর তাদের স্থলাভিষিক্ত হল এমন লোক, যারা নামায নষ্ট করল এবং ইন্দ্রিয় চাহিদার অনুগামী হল। সুতরাং অচিরেই তারা তাদের কুকর্মের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। সূরা মারইয়াম (১৯) : ৫৯
জাহান্নামীদের জিজ্ঞাসা করা হবে তোমরা কেন জাহান্নামী হলে? তারা উত্তরে বলবে, আমরা মুসল্লী (নামাযী) হতে পারিনি। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে
مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ، قالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ.
তোমাদেরকে কিসে সাকার জাহান্নাম-এ নিক্ষেপ করল? তারা বলবে, আমরা মুসল্লীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না (আমরা নামায পড়তাম না)। -সূরা মুদ্দাছ্ছির (৭৪) : ৪২-৪৩
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكُ الصَّلَاةِ.
নামায হল বান্দা ও কুফ্র-শিরকের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮২
আর বিশেষভাবে আসরের নামায তরক করার উপরেও সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে-
مَنْ تَرَكَ صَلاَةَ العَصْرِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ.
যে ব্যক্তি আসরের নামায তরক করল, তার আমল বরবাদ হল। - সহীহ বুখারী, হাদীস  ৫৫৩
সুতরাং নামায তরক করা বিষয়ে এজাতীয় সহীহ হাদীসগুলোই আমরা বলব এবং ভিত্তিহীন বর্ণনা থেকে বিরত থাকব।

একটি ভুল উচ্চারণ : তাহাজ্জুতের নামায
রাতের শেষ প্রহরে বা গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে যে নামায পড়া হয় তাকে তাহাজ্জুদের নামায বলা হয়। এর আরবী পাঠ হল, تَهَجُّد (তাহাজ্জুদ)। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ এ শব্দটিকে তাহাজ্জুত (تَهَجُت) উচ্চারণ করেন। এটি ভুল উচ্চারণ। সঠিক উচ্চারণ হল, তাহাজ্জুদ। (http://www.alkawsar.com/article/1679)
একটি বানোয়াট কিসসা : শাদ্দাদের বেহেশত
সমাজে শাদ্দাদের বেহেশত শিরোনামে বিভিন্ন ধরনের কিস্সা প্রচলিত আছে। কেউ কিস্সাটি এভাবে বলেন-
শাদ্দাদ বিশাল রাজত্ব ও ধন-সম্পদের মালিক ছিল। তার কওমের নবী তাকে দাওয়াত দিলে সে বলে, ঈমানের বদলে কী মিলবে? নবী বললেন, জান্নাত। তখন সে ঔদ্ধত্য দেখিয়ে নিজেই জান্নাত বানাতে শুরু করে।
৩০০ বছর ধরে জান্নাত বানায়; তাতে বিভিন্ন ফলের গাছ লাগায়। প্রাসাদ বানায়, নহর খনন করে ইত্যাদি। এরপর সে যখন সৈন্য-সামন্ত নিয়ে তার বানানো বেহেশতের দিকে রওনা হয়। এক দিন এক রাতের রাস্তা বাকি থাকতেই আল্লাহ তাকে তার সৈন্য-সামন্তসহ ধ্বংস করে দেন।
কেউ বলে, তার বানানো জান্নাত দেখতে যাওয়ার পথে একটি সুন্দর হরিণ দেখতে পায়। হরিণটি শিকার করতে গিয়ে সে একটু দূরে চলে যায়। এ মুহূর্তে মালাকুল মাউত হাযির হয় এবং তার রূহ কবয করে। সে তার বানানো জান্নাত নিজেও দেখতে পারে না।
কেউ বলে, সে তার বানানো বেহেশতে প্রবেশ করার জন্য যখন এক পা দিল,তখন দ্বিতীয় পা রাখার আগেই মালাকুল মাউত তার রূহ কবয করে ফেলে ইত্যাদি ইত্যাদি।
কারো কারো মুখে এ-ও শোনা যায়, এরপর আল্লাহ তাআলা তার ঐ জান্নাত যমিনে ধ্বসিয়ে দেন; মাটির সাথে মিশিয়ে দেন। বালুর মধ্যে যে অংশ চিকচিক করে, তা শাদ্দাদের বানানো বেহেশতের ধ্বংসাবশেষ।
এ ছাড়াও শাদ্দাদের বেহেশত কেন্দ্রিক আরো অনেক কথা সমাজে প্রচলিত আছে। তার বেহেশত কীভাবে বানালো, কতজন শ্রমিক লেগেছে, এর দেয়াল কিসের ছিল,ফটক কিসের ছিল, মেঝে কিসের ছিল, ইত্যাদি।
শাদ্দাদের বেহেশত বানানোর কিসসা একেবারেই অবাস্তব ও কাল্পনিক; নির্ভরযোগ্য কোনো দলীল দ্বারা তা প্রমাণিত নয়। যারা এটি উল্লেখ করেছেন তারা ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে তা এনেছেন। এজন্যই ইমাম ইবনে কাসীর ও আল্লামা ইবনে খালদুনসহ আরো অনেকেই এ কিসসাকে অবাস্তব ও কাল্পনিক বলে অভিহিত করেছেন। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৮০২-৮০৩; মুকাদ্দামাতু ইবনে খালদূন ১/১৭; আলইসরাঈলিয়্যাত ওয়াল মাওযূআত ফী কুতুবিত তাফসীর ২৮২-২৮৪

সংগৃহিত

0 on: "কিছু প্রচলিত ভুল"