Sunday, May 4, 2014

আযাদীর শিরোনাম - শহীদ টিপু সুলতান (রহ) ও ৪ই মে

আযাদীর শিরোনাম - শহীদ টিপু সুলতান (রহ) ও ৪ই মে এর উপাখ্যান  

by Abdul Hai

তরবারীর ঝলকানিতে কাপিয়ে তুলেছিলেন বাতিলের আত্মা ।তরবারীর ঝলকানিতে কাপিয়ে তুলেছিলেন বাতিলের আত্মা ।

"আজ থেকে গোটা হিন্দুস্তান আমাদের" কথাটি বলেছিলেন জেনারেল হার্স, যে দিন হিন্দুস্তানের বীর সেনানী টিপু সুলতান শাহাদাত বরণ করেছিলেন।তারঁ এই শাহাদাতের মধ্য দিয়ে বস্তুত গোটা হিন্দুস্থানের ওপর নেমে এসেছিল পরাধীনতার অন্ধকার। টিপু সুলতান যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন ইংরেজদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছেন, দেশের স্বাধীনতা আগলে রেখেছেন।কিন্তু তিনি শাহাদাত বরণ করলে শুধু হিন্দুস্থানই নয়,গোটা মুসলিম বিশ্ব যেন স্বাধীনতার এক অতন্দ্রপ্রহরী হারিয়ে অভিভাবক হারা অবস্থায় পড়ে যায়। তাই টিপু সুলতান ছিলেন ভারতবাসীর জন্য একজন চিরস্মরণীয় বীর। কিন্তু ইতিহাস বিকৃতি আর আমাদের উদাসীনতায় এই মুসলিম বীর আমাদের কাছে হয় অপরিচিত থেকেছেন নতুবা এমন পরিচয় লাভ করেছেন যা তার মতো মহান বীরের জন্য অবমাননার শামিল।



টিপু সুলতান রহ: এর জন্মস্থান এর স্মৃতিস্তম্ভ ।টিপু সুলতান রহ: এর জন্মস্থান এর স্মৃতিস্তম্ভ ।

টিপু সুলতান যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন বাংলা, বিহার সহ ভারতের অনেক অংশই ব্রিটিশরা দখল করে ফেলে। তাঁর নাম টিপু সুলতান রাখার কারণ হলো,তার জন্মের পর তার দেহ জুড়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল বিখ্যাত বুযুর্গ হযরত টিপু সুলতান (রহ) এর রুহানী ফয়েজের ঝলক। যেন এই শিশুটি তাঁরই প্রতিবিম্ব। তাই তাঁর নামের সাথে মিল রেখে এ শিশুটির নাম রাখা হয় টিপু সুলতান।


গ্রীষ্মকালীণ অবকাশ প্রাসাদ। সেরিঙ্গাপাটনা, কর্নাটক।গ্রীষ্মকালীণ অবকাশ প্রাসাদ। সেরিঙ্গাপাটনা, কর্নাটক।

টিপু সুলতান ছিলেন একজন সত্যিকার আলেম ও মুমিন ব্যক্তি। পিতা হায়দার আলী নিজে নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও তিনি পুত্র টিপুর জন্য উত্তম শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। ইলম ও জাগতিক শিক্ষার সাথে সাথে তিনি অল্প বয়সে যুদ্ধ বিদ্যা রপ্ত করেন।১৭৬৭ সালে মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে মহীশুরের প্রথম যুদ্ধে সাত হাজার সৈন্যের এক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন এবং বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন করে ইংরেজদের পরাস্ত করেন। সেই সতের বছর বয়সে যে টিপু সুলতান ইসলামের দুশমনের বিরুদ্ধে হাতিয়ের তুলে নেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সেই হাতিয়ার বীরত্বের উজ্জ্বল নমুনা হয়ে থাকে।

টিপু সুলতানের ব্যবহৃত কামানটিপু সুলতানের ব্যবহৃত কামান

টিপু সুলতান শুধু একজন শাসকই ছিলেন না,একজন আমলদার আলেমও ছিলেন। মুজাহিদে মিল্লাত হযরত টিপু সুলতান(রহ) ছিলেন অন্তন্ত দৃঢ় ও বিশুদ্ধ আকীদার মুসলমান।সুন্নাতে নববীর অনুসরণে ছিলেন অনুপম দৃষ্টান্ত।বর্তমান কালে বিভিন্ন সময়ে তাঁর নামে প্রদর্শিত ফটো কস্মিনকালেও তাঁর ছবি নয়।কারণ তাঁর মুখাবয়ব ছিল ঘন শ্মশ্রুমন্ডিত।।সাত-আট বছর বয়সে খেলাধুলায় মত্ত একদল শিশুর সাথে তাকে দেখে জৈনিক দরবেশ তাকে কাছে ডেকে নেন এবং ভবিষ্যত শাসক হওয়ার সুসংবাদ দিয়ে তার কাছ থেকে ওয়াদা নেন যে,তিনি শাসক হওয়ার পর ঠিক এই জায়গায় এই জায়গায় একটি শানদার মসজিদ নির্মাণ করবেন ।শাসক হওয়ার পর ওয়াদামাফিক তিনি মসজিদে আলা নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং ১২০৪ হিজরী মোতাবেক ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এর উদ্বোধন করেন।



এ উপলক্ষে তিনি দেশের ওলামা-মাশায়েখ এবং বুযুর্গানে কেরামকে দাওয়াত দেন।এবং ঘোষণা করেন,আজকের উদ্বোধনী দিনে সেই ব্যক্তি নামাজের ইমামতি করবেন যিনি সাহেবে তারতীব অর্থাৎ বালেগ হওয়ার পর জীবনে কখনো নামাজ কাজা হয়নি।কিন্তু কি আশ্চর্য ! কেউই তখন সামনে অগ্রসর হয়নি।অবস্থা দেখে টিপু সুলতান নামাজের ইমামতি করেন এবং বলেন "আলহামদু লিল্লাহ ,আমি সাহেবে তারতীব।"
সারা জীবনে অব্যাহতভাবে যুদ্ধে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও কখনো তাঁর নামাজ কাযা হয়নি দেখে উপস্থিত লোকজন যারপর নাই হয়রান হয়ে যান।



টিপু সুলতান (রহ.) এর নির্মিত একটি মাসজিদ ।টিপু সুলতান (রহ.) এর নির্মিত একটি মাসজিদ ।
ইতিহাসের অকুতোভয় বীর সেনানী হযরত টিপু সুলতান(রহ) প্রতিনিয়ত অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করতেন।তাঁর অনুপম লজ্জাশীলতা সম্পর্কে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে,তাঁর দু'পায়ের টাখনু,হস্তদ্বয় এবং মুখমন্ডল ব্যতীত গোটা শরীরই আবৃত থাকত।কখনও তিনি কারো সামনে অন্য কোন অঙ্গ অনাবৃত করতেন না।


সুলতানের আমলের পয়সা ।সুলতানের আমলের পয়সা ।
একবার নেজাম ও মারাঠা বাহিনী তানগবাদড়া সাগরের পাড়ে সমবেত হয় টিপু সুলতানের বাহিনীর ওপর আক্রমণ করার জন্য।টিপু ছিলেন সমুদ্রের অপর পাড়ে এবং সে সময় সমুদ্র ছিল ভংকর রকম উত্তাল।সাগরের উত্তালতা দেখে তাঁর আমর ইবনুল আস(রা) ও নীল দরিয়ার ঘটনার কথা মনে পড়ে এবং তিনি ভাবেন,সাচ্চা মুসলমানের জবানে আল্লাহ তায়ালা এখনো তাছীর রেখেছেন। এই বলে তিনি আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দু'আ করেন এবং তার আদেশে মুজাহিদরা সমুদ্রে একুশবার গোলা ছোঁড়ে। এর কিছুক্ষণ পর সমুদ্রের উত্তালতা থেমে যায়। টিপু সুলতানের কারামত দেখে মুজাহিদরা তাকবীর ধ্বনি দিয়ে দুশমনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।



টিপু সুলতান ছিলেন একজন ইলম জ্ঞান প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন জ্ঞান আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। জাওয়াহিরুল কোরআন(পবিত্র কোরআনের মুক্তামালা),যাদুল মুজাহিদীন(মুজাহিদের পাথেয়),মুফাররেহুল কুলুব(আত্মার প্রশান্তি) এসব প্রখর জ্ঞান সমৃদ্ধ কিতাবাদী তাঁরই একান্ত তত্ত্বাবধানে রচিত হয়।টিপু সুলতান ছিলেন হিন্দুস্তানের এক বিরল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শাসক।ভারত উপমহাদেশে তিনিই সর্বপ্রথম উর্দু পত্রিকা প্রকাশ করেন।'ফাতহুল মুজাহিদীন' নামে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকাটি তার তত্ত্বাব্ধানে প্রকাশিত হত এবং এতে মুজাহিদদের দায়িত্ব ও করণীয় সম্পর্কে উল্লেখ থাকত।


আন্তর্জাতিক বিষয়েও তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দেন।তিনি তাঁর শাসনাকালীন সময়ে ফ্রান্সের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেন।ইংরেজ বীরোধিতা তখন দু'টি দেশকে একই প্লাটফর্মে নিয়ে আসে।সে সময় তিনি আফগানিস্তানের তৎকালীন বাদশাহকেও আপন বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন।

টিপু সুলতান রহ: এর ব্যবহৃত বন্দুকটিপু সুলতান রহ: এর ব্যবহৃত বন্দুক

ইংরেজরা একমাত্র তার প্রতিরোধের কারণেই গোটা হিন্দুস্তান কব্জা করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। একারণে তারা তাঁর বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।হাজার হাজার লোককে গাদ্দারে পরিণত করে। মহীশুর বাহিনীর সাথে ইংরেজ বাহিনীর ফয়সালাকারী যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৭৯৯ সালের মে মাসে। ৪ মে ফজরের নামাজ আদায় করে টিপু সুলতান শত্রু বাহিনীর মোকাবেলায় অবতীর্ণ হন। গাদ্দার পরিবেষ্টিত হয়ে তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়। এমনকি তার ব্যক্তিগত ও খাস খাদেম গোলাম রাজা খানও তার সাথে চরম গাদ্দারী করে।তার কাছে পানি থাকা স্তত্বেও সে সুলতাকে পানি দিতে অস্বীকার করে এবং সুলতান সারা দিন পানির পিপাসায় ছটফট করেন। এই গাদ্দারই তাকে দুশমনের হাতে আত্মসমর্পনের কুপরামর্শ দেয়।সে সময় তাকে লক্ষ করেই টিপু সুলতান সেই বিখ্যত উক্তিটি করেন- "আমার কাছে সিংহের একদিন জীবন শিয়ালের শত বছরের জীবনের চেয়ে উত্তম।"

টিপু সুলতানের আমলের একটি দুর্গটিপু সুলতানের আমলের একটি দুর্গ

সকালে অব্যাহত লড়াইয়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।আসমানের বাসিন্দারা আল্লাহর এই মকবুল বান্দাকে ইস্তেকবাল করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। বিকেলের কোন এক সময় মহীশুরের এক গাদ্দার ইংরেজদেরকে ইশারা করে বলে দেয় ইনিই হলেন টিপু সুলতান।তৎক্ষণাৎ দুশমনেরা বন্দুকের সকল নল তার দিকে তাক করে এবং চতুর্দিক থেকে অবিরাম গোলা বর্ষণ হতে থাকে।একটি গুলি এসে তার বুকে বিদ্ধ হয় এবং তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এসময় একজন সৈনিক তার কোমরে ঝুলানো হীরা খচিত শমসীর খুলে নিতে চাইলে তার আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে,তখন তিনি তার সকল শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং তলোয়ার দিয়ে তার উপর আঘাত করেন।সে বন্দুকের সাহায্যে আঘাত প্রতিহত করলেও অন্য একজন ইংরেজ সৈনিক এতে প্রাণ হারায়। সে সময়ে নিকটে অবস্থিত অন্য একজন ইংরেজ সৈনিক তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে তার কানে গিয়ে তা আঘাত করে।এই গুলিতে টিপু সুলতানের শাহাদাত বরণ করেন,সেই সাথে হিন্দুস্তানের আযাদীর সূর্যও অস্তমিত হয়।সে দিনটি ছিল ১৭৯৯ ইংরেজী সালের ৪ ই মে।




পরের দিন ৫ মে তাকে গোসল ও কাফন দেওয়া হয়। লক্ষ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান তাঁকে শেষ বারের মত দেখার জন্য ভীড় করে। হিন্দু মহিলারা মাথায় মাটি নিক্ষেপ করে শোক প্রকাশ করতে থাকে। লালবাগে পৌঁছানোর পর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শহরের কাজী জানাজার ইমামতি করেন। নামাযান্তে মহীশুর রণক্ষেত্র থেকে আট মাইল দূরে সেরিঙ্গা পট্টম নামক স্থানে পিতা হায়দার আলীর কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।

বাব-মায়ের কববের পাশাপাশি শহীদ টিপু সুলতানবাব-মায়ের কববের পাশাপাশি শহীদ টিপু সুলতান

এভাবেই ভারত উপমহাদেশের একজন স্বাধীনচেতা ,দেশপ্রেমিক, লড়াকু সৈনিক ও অকুতোভয় আলেম শাসকের জীবনাসান হয়।

লাল পতাকায় উড়ছে একটি ইতিহাস..........লাল পতাকায় উড়ছে একটি ইতিহাস..........
ব্লগার  “অগ্রপথিক”  এর লেখা থেকে পরিমার্জিত ও নোটাকারে প্রকাশের উপযোগী করে তৈরী করা।

0 on: "আযাদীর শিরোনাম - শহীদ টিপু সুলতান (রহ) ও ৪ই মে"