Monday, May 5, 2014

ইসলামে আসার গল্প : শাইখ মির্জা ইওয়ার বেইগের বইয়ের চমৎকার একটি ঘটনা

- No comments

ইসলামে আসার গল্প : শাইখ মির্জা ইওয়ার বেইগের বইয়ের চমৎকার একটি ঘটনা

সানজিদা শারমিন
 
শাইখ মির্জা ইওয়ার বেইগের বইয়ের চমৎকার একটি ঘটনা।
-----------------------------------

আমি হার্টফোর্ড থেকে লস অ্যাঞ্জেলে যাওয়ার জন্য নর্থওয়েস্ট এয়ারলাইনসে ভ্রমণ করছিলাম। ডেট্রয়েটে ওদের একটি হাব আছে তাই বিমান সেখানে থামল। দুর্ভাগ্যবশত আমার সিটটি ছিল মাঝখানে। চিন্তা করুন, অ্যামেরিকার মধ্যে ৬ ঘণ্টার বেশি সময় ইকনমি ক্লাসের তাও আবার মাঝের সিটে বসে ভ্রমণ করার বিষয়টি কতখানি বিরক্তিকর হতে পারে। দিনটি ছিল শুক্রবার। আমি একটি লম্বা সাদা জুব্বা পরাছিলাম, তার উপর ছিল (জুব্বার উপর পরিধানের) একটি মিশলাহ এবং মাথায় ছিল সাদা পাগড়ী। হার্টফোর্ড এয়ারপোর্টে এক মহিলা আমার কাছে এসে বলল, ‘আপনি কী সুলতান?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘জি না, ম্যাডাম, এখনো হইনি।’ তারপর দুজনেই হাসলাম। আমরা বিমানে উঠলাম এবং ডেট্রয়েটে দিকে এটা উড়া শুরু করল। জানালার পাশের লোকটি ডেট্রয়েটে নেমে গেলো। তারপর একজন সাদা চামড়ার অ্যামেরিকান মহিলা এসে বসল।

বিমান যখন আবার উড়া শুরু করল আমি কুরআনটা বের করে সূরা আল-কাহাফ পড়া শুরু করলাম। শুক্রবারে সূরা কাহাফ পাঠ করা সুন্নাহ। আমি খেয়াল করছিলাম জানালার পাশের সেই মহিলাটি পাশ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে এবং আমি কী পড়ছি তা দেখার চেষ্টা করছে। কয়েক মিনিট পর সে আমাকে বলল, ‘আপনি কী পড়ছেন?’

‘ম্যাডাম, আমি কুরআন পড়ছি।’
‘এটা কোন ভাষা?’
‘আরবী’
তারপর মহিলাটি কাত হয়ে সামনের সিটের নিচে রাখা তার হাতব্যাগটি থেকে একটা লকেট বের করে আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘আপনি কী এটা পড়তে পারেন?’

লকেটটা ছিল রুপার যার এপাশে লেখা ছিল সুবহান আল্লাহ এবং অন্য পাশে আলহামদুলিল্লাহ। আমার জানার কৌতূহল হলো যে সে এটা কোথায় পেয়েছে। আমি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম, ‘এর মানে সকল প্রশংসা আল্লাহর’ এবং এর মানে ‘সকল প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা আল্লাহর জন্য।’ তারপর আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, আপনি এটা কোথায় পেয়েছেন?’ সে হেসে আমাকে একটা চমৎকার গল্প বলল। আমার যতটুকু মনে আছে আমি তা এখানে তা তুলে আনার চেষ্টা করছি।

সে বলল, ‘এই লকেটটা আমার দাদী আমাকে দিয়েছে। আমার দাদীকে এই লকেটটা তার এক ইরানী বান্ধবী এ কথা বলে দিয়েছিল যে, ‘এটা তার জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে। এতে কী লেখা আছে তা আমার অজানা ছিল। যখন আমি আপনাকে দেখলাম, আমার মনে হয়েছে যে আপনি বলতে পারবেন। তাই আমি আপনাকে দেখিয়েছি।’

তারপর সে বলল, ‘আপনি জানেন, আপনার সাথে আমার দেখা হওয়ার বিষয়টি কোনো আকস্মিক বিষয় নয়। আমি লস অ্যাঞ্জেলে থাকি। একটা কনফারেন্সে ডেট্রয়েটে এসেছি। গতকাল আমার কনফারেন্স শেষ হয়ে গিয়েছে। আমার লস অ্যাঞ্জেলে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কিছু একটা আমাকে আটকে দিল। বলল, আরেকটা দিন থেকে যেতে। আমি আমার টিকেট বাতিল করে নর্থওয়েস্ট এয়ারলাইনসে আজকের টিকেট কিনেছি। আমি আগে কখনোই নর্থওয়েস্টে ভ্রমণ করিনি।’ তার কথার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য সে আমাকে বাতিল করা টিকেটটা দেখালো। আমি এত বিস্মিত ছিলাম যে কিছু বলার ভাষা পাচ্ছিলাম না।

সে বলল, ‘কাল সন্ধ্যায়, আমি একা একা বসে আমার হোটেলের রুমে টিভি দেখছিলাম আর ভেবে অবাক হচ্ছিলাম যে আমি ডেট্রয়েটে বসে আছি কেন। কেন আমি একরাতের জন্য বেশি টাকা ব্যয় করে এখানে রয়ে গিয়েছি? অথচ আমার সব বন্ধু ও সহকর্মীরা যে যার বাড়িতে চলে গিয়েছে। তারপর আজ সকালে যখন এই ফ্লাইটে আপনার সাথে দেখা হলো তখন আপনি আমাকে লেখাটির মানে বললেন। আপনি যেটা পড়ছিলেন সেটা কি একটু শব্দ করে পড়বেন, প্লীজ? আমার শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে।’

আমি শব্দ করে সূরা আল কাহাফ পাঠ করলাম। যখন পাঠ শেষে কুরআন বন্ধ করলাম, সে বিস্মিত হয়ে বলল, ‘চমৎকার। শেষ হয়ে গিয়েছে? আমি ভেবেছিলাম আপনি বইয়ের শেষ পর্যন্ত পাঠ করবেন।’ আমার চোখ অশ্রু সিক্ত হয়ে উঠল। একজন মহিলা যে কুরআনের একটি শব্দও বুঝে না। তারপরও সে আরও বেশি বেশি শুনতে চাচ্ছে। এটাই হলো আমাদের রবের কালামের অলৌকিকত্ব—যারা বুঝতে পারে না তাদের অন্তরকেও তা ছুয়ে যায়।

আমি আল্লাহর কাছে দুআ করলাম, ‘ইয়া রাব্বী, তোমার দ্বীনের প্রতি এই মহিলার অন্তরকে খুলে দাও। আমি বুঝতে পারছি না, কীভাবে তাকে ইসলাম সম্পর্কে বলব। দয়াকরে তাকে দিয়ে আমাকে প্রশ্ন করাও।’

তারপর সে আমাকে বলল, ‘আপনি কি আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলবেন?’

আমি বললাম, ‘ইসলাম হলো কেবলমাত্র আমাদের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তার ইবাদত করা এবং তাঁর ক্ষমতা, মহমা ও গরিমার ক্ষেত্রে কোনো অংশীদার স্থাপন না করা। কারণ তিনি কোনোরূপ সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই সবকিছু একা সৃষ্টি করেছেন এবং কারও সাহায্য ছাড়াই তিনি একা গোটা সৃষ্টি জগতকে প্রতিপালন করছেন এবং কারও সাহায্য ছাড়াই তিনি এই সবকিছুকে তিনি ধ্বংস করবেন। তারপর আমাদের সবাইকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে। ইসলাম হলো মুহাম্মদ (সা.)কে আল্লাহর প্রেরিত নবুওয়াতের ধারার সর্বশেষ নবী হিসেবে মেনে নেওয়া।’

ইসলাম হলো আল্লাহর রাসুলদের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য না করে তাদের সবার উপর ঈমান আনা। ইসলাম হলো তাদের সবাইকে আল্লাহর রাসুল হিসেবে মেনে নেওয়া। তাদেরকে যে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল তারা তা যথাযথভাবে পালন করেছেন। সেটা হলো আল্লাহর সাথে কোনো অংশীদার স্থাপন না করে মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান করার দায়িত্ব। আমরা মুসলিমরা নূহ, ইবরাহীম, মুসা এবং যিশু (ঈশা (আ.)) এবং আল্লাহর অন্যান্য সব নবী রাসুলকে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি যে আল্লাহ তায়ালা শুধুমাত্র এই কয়েকজন নবী-রাসুলকেই পাঠাননি বরং তিনি পৃথিবীর প্রত্যেকটা স্থানে প্রত্যেক জাতির কাছে নবী-রাসুল পাঠিয়েছিলেন। তাদের কতিপয়ের কথা আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করেছেন এবং অন্যান্যদের কথা তিনি উল্লেখ করেননি। ইসলাম হলো মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে বিশ্বাস করা এবং বিচার দিবসের উপর ঈমান আনা। সেদিন আমাদেরকে আমাদের কাজের হিসাব দেওয়ার জন্য আহবান করা হবে এবং তার উপর নির্ভর করে আমাদের জান্নাতে অথবা জাহান্নামে পাঠানো হবে।

সে মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনল এবং এমনভাবে মাথা নাড়াল যেন সে আমার কথায় সম্মতি প্রকাশ করছে। ‘যিশু সম্পর্কে আপনারা কী বলেন?’ সে প্রশ্ন করল।

‘আমরা তা-ই বলি যা আল্লাহর কিতাবে বলা হয়েছে’ আমি বললাম। ‘আমরা বলি যে তিনি ছিলেন কুমারী মারিয়াম (আ.)এর পুত্র। আল্লাহর পুত্র নন। আল্লাহ তায়ালা জিবরীল (আ.)কে তার মা মারিয়াম (আ.)এর কাছে পাঠান যিনি ছিলেন একজন ধার্মিক নারী। জিবরীল (আ.) তাকে পুত্র সন্তান জন্মের সুসংবাদ দেন। মারিয়াম (আ.) বলেন, ‘কীভাবে আমার সন্তান হবে অথচ আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি?’

জিবরীল (আ.) উত্তর দেন, ‘আপনার রবের জন্য এটা সহজ।’ তারপর ঈশা (আ.) একজন কুমারী মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম গ্রহণ করেন। ঈশা (আ.) ছিলেন আল্লাহর রাসুল যিনি জন্মের পর শৈশবে কথা বলেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে অনেক অলৌকিক ক্ষমতা দান করেছিলেন। তিনি কুষ্ঠ রোগিদের সুস্থ করতেন, অন্ধদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতেন এবং মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতে পারতেন এবং আরও অনেক অলৌকিক ক্ষমতা দেখিয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি যে তিনি এই অলৌকিক কাজগুলো করেছেন আল্লাহর ইচ্ছায়, তার নিজের ক্ষমতায় নয়। তিনি এসেছিলেন বনী ইসরাইলদেরকে মুসা (আ.)এর আনিত বিধানের দিকে ফিরিয়ে নিতে এবং তাদেরকে পৃথিবীতে ফিতনা-ফ্যাসাদ ছড়ানোর বিরুদ্ধে সতর্ক করতে। তারা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তারা সফল হয়নি। আল্লাহ তায়ালা তাকে বাঁচিয়েছেন এবং জীবিত অবস্থায় তার কাছে তুলে নিয়েছেন।

আমরা বিশ্বাস করি যে ঈশা (আ.) পৃথিবী ধ্বংসের আগে আবার ফিরে আসবেন এবং তার আগমন হলো কিয়ামতের একটি লক্ষণ। তিনি দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। তখন মুসলিমরা ঈশা (আ.) এর পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করবে। আমরা বিশ্বাস করি যে তিনি তখন অন্যান্য মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করবেন, বিয়ে করবেন, মৃত্যু বরন করবেন এবং তাকে কবর দেওয়া হবে।’

আমার কথাব শুনে সে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল এবং বলল, ‘আপনার কথায় যৌক্তিকতা আছে। যীশু মানুষের পাপের জন্য ক্রসে ঝুলে মারা গিয়েছে—এ ব্যাপারে আপনাদের মতামত কী?’

‘আমরা বলি যে আল্লাহ তায়ালা অবিচারক নন। অন্য মানুষের পাপের জন্য একটা নিস্পাপ মানুষকে ভয়ঙ্করভাবে মৃত্যুর শাস্তি দেওয়া একটি বড় ধরনের অবিচার। তাছাড়া কাউকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা অন্য কাউকে শাস্তি দিতে বাধ্য নন। আল্লাহ যদি ক্ষমা করে দিতেই চান তাহলে তিনি তা এমনিই পারেন। কারণ তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ক্ষমা পাওয়ার জন্য সত্যিকারভাবে অনুতপ্ত হয়ে আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। আল্লাহ তায়ালা তাহলেই ক্ষমা করে দিবেন। এর জন্য আর বেশি কিছু করার দরকার নেই।’

সে আরও একবার মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি একমত। স্রষ্টা কি অন্যদের পাপের জন্য একজন নিস্পাপ মানুষকে শাস্তি দিতে পারেন?’ তারপর সে বলল, ‘আচ্ছা, কীভাবে মুসলিম হতে হয়?’

আমি বললাম, ‘বলতে হবে যে, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহি (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া ইবাদাতের যোগ্য কোনো ইলাহা নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসুল); এবং অন্তর থেকে এর উপর ঈমান আনতে হবে। অন্তর থেকে সব ধরনের মিথ্যা বিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে। এমনকি এটাও বিশ্বাস করা যাবে না যে যীশু আল্লাহর পুত্র। মনে করা যাবে না যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মানুষ, ফেরেশতা অথবা অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য অথবা তারা কোনোভাবে কোনো কল্যাণ বা অকল্যাণ ঘটানোর ক্ষমতা রাখে।’

‘এতটুকুই?’ আমি যদি শুধু এতটুকু বলি এবং আমার অন্তর থেকে বিশ্বাস করি তাহলেই আমি মুসলিম হয়ে যাবো?’

‘জি হ্যাঁ, আপনি এই বাক্য পাঠ করলে আর অন্তর থেকে বিশ্বাস করলেই মুসলিম হয়ে যাবেন।’ আমি উত্তর দিলাম।

‘আমাকে আর কী করতে হবে?’ সে প্রশ্ন করল।

আমি বললাম, ‘দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাহ আদায় করতে হবে, আপনার উদ্ধৃত্ত সম্পদের ২.৫ শতাংশ প্রতি বছর দান করে দিতে হবে এবং রমাদান মাসে রোজা রাখতে হবে। আর আপনি যদি পারেন তাহলে জীবনে একবার আল্লাহর ঘরে হজ্ব করবেন। খাদ্যের ব্যাপারে আল্লাহর বিধানগুলো মেনে চলবেন (শূকরের মাংস খাবেন না, মদ পান করবেন না অথবা কোনো নেশা জাতিয় দ্রব্য সেবন করবেন না), ন্যায়পরায়ণ, দায়িত্বশীল ও নৈতিক জীবন যাপন করবেন। সবসময় সচেতন থাকবেন যে আপনাকে আপনার কাজকর্মের হিসাব দিতে হবে।’

সে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কি এখনই মুসলিম হতে পারব?’

কথাটা শুনে আমার অন্তর বলে উঠল, ‘ইয়া আল্লাহ, তুমি আমার ও তার রব। তুমি আমাকে আজ দেখালে যে কীভাবে তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে হিদায়েতের পথে আনো কারও সাহায্য ছাড়াই। ইয়া আল্লাহ, তোমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের কোনো ভাষা আমার জানা নেই। আমি তোমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি সেই শব্দের দ্বারা যা তোমার শান ও মর্যাদার সাথে মানানসই।’

আমি বললাম, ‘জি, আপনি চাইলে এখনি মুসলিম হতে পারেন।’

‘তাহলে বলুন আমাকে কী করতে হবে।’

‘আমার সাথে সাথে পাঠ করুন, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অয়া আশাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহি।’ সে পাঠ করল এবং ভূমি থেকে ৩৫,০০০ ফুট উপরে বাতাসের মধ্যে যখন আমরা ঘণ্টায় ৯০০ মাইল বেগে চলছিলাম সে অবস্থায় সে ইসলামের প্রশান্তির ছায়াতলে প্রবেশ করল। এটাই হলো আমার রবের দয়া। আলহামদুলিল্লাহ

(লেখকের journy of faith বই থেকে অনুদিতঃ বইটি সিয়ান পাবলিকেশনের ব্যানারে শিঘ্রই প্রকাশিত হবে ইনশা আল্লাহ) 
collected from shomokalin

Sunday, May 4, 2014

আযাদীর শিরোনাম - শহীদ টিপু সুলতান (রহ) ও ৪ই মে

- No comments

আযাদীর শিরোনাম - শহীদ টিপু সুলতান (রহ) ও ৪ই মে এর উপাখ্যান  

by Abdul Hai

তরবারীর ঝলকানিতে কাপিয়ে তুলেছিলেন বাতিলের আত্মা ।তরবারীর ঝলকানিতে কাপিয়ে তুলেছিলেন বাতিলের আত্মা ।

"আজ থেকে গোটা হিন্দুস্তান আমাদের" কথাটি বলেছিলেন জেনারেল হার্স, যে দিন হিন্দুস্তানের বীর সেনানী টিপু সুলতান শাহাদাত বরণ করেছিলেন।তারঁ এই শাহাদাতের মধ্য দিয়ে বস্তুত গোটা হিন্দুস্থানের ওপর নেমে এসেছিল পরাধীনতার অন্ধকার। টিপু সুলতান যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন ইংরেজদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছেন, দেশের স্বাধীনতা আগলে রেখেছেন।কিন্তু তিনি শাহাদাত বরণ করলে শুধু হিন্দুস্থানই নয়,গোটা মুসলিম বিশ্ব যেন স্বাধীনতার এক অতন্দ্রপ্রহরী হারিয়ে অভিভাবক হারা অবস্থায় পড়ে যায়। তাই টিপু সুলতান ছিলেন ভারতবাসীর জন্য একজন চিরস্মরণীয় বীর। কিন্তু ইতিহাস বিকৃতি আর আমাদের উদাসীনতায় এই মুসলিম বীর আমাদের কাছে হয় অপরিচিত থেকেছেন নতুবা এমন পরিচয় লাভ করেছেন যা তার মতো মহান বীরের জন্য অবমাননার শামিল।



টিপু সুলতান রহ: এর জন্মস্থান এর স্মৃতিস্তম্ভ ।টিপু সুলতান রহ: এর জন্মস্থান এর স্মৃতিস্তম্ভ ।

টিপু সুলতান যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন বাংলা, বিহার সহ ভারতের অনেক অংশই ব্রিটিশরা দখল করে ফেলে। তাঁর নাম টিপু সুলতান রাখার কারণ হলো,তার জন্মের পর তার দেহ জুড়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল বিখ্যাত বুযুর্গ হযরত টিপু সুলতান (রহ) এর রুহানী ফয়েজের ঝলক। যেন এই শিশুটি তাঁরই প্রতিবিম্ব। তাই তাঁর নামের সাথে মিল রেখে এ শিশুটির নাম রাখা হয় টিপু সুলতান।


গ্রীষ্মকালীণ অবকাশ প্রাসাদ। সেরিঙ্গাপাটনা, কর্নাটক।গ্রীষ্মকালীণ অবকাশ প্রাসাদ। সেরিঙ্গাপাটনা, কর্নাটক।

টিপু সুলতান ছিলেন একজন সত্যিকার আলেম ও মুমিন ব্যক্তি। পিতা হায়দার আলী নিজে নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও তিনি পুত্র টিপুর জন্য উত্তম শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। ইলম ও জাগতিক শিক্ষার সাথে সাথে তিনি অল্প বয়সে যুদ্ধ বিদ্যা রপ্ত করেন।১৭৬৭ সালে মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে মহীশুরের প্রথম যুদ্ধে সাত হাজার সৈন্যের এক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন এবং বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন করে ইংরেজদের পরাস্ত করেন। সেই সতের বছর বয়সে যে টিপু সুলতান ইসলামের দুশমনের বিরুদ্ধে হাতিয়ের তুলে নেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সেই হাতিয়ার বীরত্বের উজ্জ্বল নমুনা হয়ে থাকে।

টিপু সুলতানের ব্যবহৃত কামানটিপু সুলতানের ব্যবহৃত কামান

টিপু সুলতান শুধু একজন শাসকই ছিলেন না,একজন আমলদার আলেমও ছিলেন। মুজাহিদে মিল্লাত হযরত টিপু সুলতান(রহ) ছিলেন অন্তন্ত দৃঢ় ও বিশুদ্ধ আকীদার মুসলমান।সুন্নাতে নববীর অনুসরণে ছিলেন অনুপম দৃষ্টান্ত।বর্তমান কালে বিভিন্ন সময়ে তাঁর নামে প্রদর্শিত ফটো কস্মিনকালেও তাঁর ছবি নয়।কারণ তাঁর মুখাবয়ব ছিল ঘন শ্মশ্রুমন্ডিত।।সাত-আট বছর বয়সে খেলাধুলায় মত্ত একদল শিশুর সাথে তাকে দেখে জৈনিক দরবেশ তাকে কাছে ডেকে নেন এবং ভবিষ্যত শাসক হওয়ার সুসংবাদ দিয়ে তার কাছ থেকে ওয়াদা নেন যে,তিনি শাসক হওয়ার পর ঠিক এই জায়গায় এই জায়গায় একটি শানদার মসজিদ নির্মাণ করবেন ।শাসক হওয়ার পর ওয়াদামাফিক তিনি মসজিদে আলা নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং ১২০৪ হিজরী মোতাবেক ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এর উদ্বোধন করেন।



এ উপলক্ষে তিনি দেশের ওলামা-মাশায়েখ এবং বুযুর্গানে কেরামকে দাওয়াত দেন।এবং ঘোষণা করেন,আজকের উদ্বোধনী দিনে সেই ব্যক্তি নামাজের ইমামতি করবেন যিনি সাহেবে তারতীব অর্থাৎ বালেগ হওয়ার পর জীবনে কখনো নামাজ কাজা হয়নি।কিন্তু কি আশ্চর্য ! কেউই তখন সামনে অগ্রসর হয়নি।অবস্থা দেখে টিপু সুলতান নামাজের ইমামতি করেন এবং বলেন "আলহামদু লিল্লাহ ,আমি সাহেবে তারতীব।"
সারা জীবনে অব্যাহতভাবে যুদ্ধে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও কখনো তাঁর নামাজ কাযা হয়নি দেখে উপস্থিত লোকজন যারপর নাই হয়রান হয়ে যান।



টিপু সুলতান (রহ.) এর নির্মিত একটি মাসজিদ ।টিপু সুলতান (রহ.) এর নির্মিত একটি মাসজিদ ।
ইতিহাসের অকুতোভয় বীর সেনানী হযরত টিপু সুলতান(রহ) প্রতিনিয়ত অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করতেন।তাঁর অনুপম লজ্জাশীলতা সম্পর্কে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে,তাঁর দু'পায়ের টাখনু,হস্তদ্বয় এবং মুখমন্ডল ব্যতীত গোটা শরীরই আবৃত থাকত।কখনও তিনি কারো সামনে অন্য কোন অঙ্গ অনাবৃত করতেন না।


সুলতানের আমলের পয়সা ।সুলতানের আমলের পয়সা ।
একবার নেজাম ও মারাঠা বাহিনী তানগবাদড়া সাগরের পাড়ে সমবেত হয় টিপু সুলতানের বাহিনীর ওপর আক্রমণ করার জন্য।টিপু ছিলেন সমুদ্রের অপর পাড়ে এবং সে সময় সমুদ্র ছিল ভংকর রকম উত্তাল।সাগরের উত্তালতা দেখে তাঁর আমর ইবনুল আস(রা) ও নীল দরিয়ার ঘটনার কথা মনে পড়ে এবং তিনি ভাবেন,সাচ্চা মুসলমানের জবানে আল্লাহ তায়ালা এখনো তাছীর রেখেছেন। এই বলে তিনি আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দু'আ করেন এবং তার আদেশে মুজাহিদরা সমুদ্রে একুশবার গোলা ছোঁড়ে। এর কিছুক্ষণ পর সমুদ্রের উত্তালতা থেমে যায়। টিপু সুলতানের কারামত দেখে মুজাহিদরা তাকবীর ধ্বনি দিয়ে দুশমনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।



টিপু সুলতান ছিলেন একজন ইলম জ্ঞান প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন জ্ঞান আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। জাওয়াহিরুল কোরআন(পবিত্র কোরআনের মুক্তামালা),যাদুল মুজাহিদীন(মুজাহিদের পাথেয়),মুফাররেহুল কুলুব(আত্মার প্রশান্তি) এসব প্রখর জ্ঞান সমৃদ্ধ কিতাবাদী তাঁরই একান্ত তত্ত্বাবধানে রচিত হয়।টিপু সুলতান ছিলেন হিন্দুস্তানের এক বিরল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শাসক।ভারত উপমহাদেশে তিনিই সর্বপ্রথম উর্দু পত্রিকা প্রকাশ করেন।'ফাতহুল মুজাহিদীন' নামে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকাটি তার তত্ত্বাব্ধানে প্রকাশিত হত এবং এতে মুজাহিদদের দায়িত্ব ও করণীয় সম্পর্কে উল্লেখ থাকত।


আন্তর্জাতিক বিষয়েও তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দেন।তিনি তাঁর শাসনাকালীন সময়ে ফ্রান্সের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেন।ইংরেজ বীরোধিতা তখন দু'টি দেশকে একই প্লাটফর্মে নিয়ে আসে।সে সময় তিনি আফগানিস্তানের তৎকালীন বাদশাহকেও আপন বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন।

টিপু সুলতান রহ: এর ব্যবহৃত বন্দুকটিপু সুলতান রহ: এর ব্যবহৃত বন্দুক

ইংরেজরা একমাত্র তার প্রতিরোধের কারণেই গোটা হিন্দুস্তান কব্জা করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। একারণে তারা তাঁর বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।হাজার হাজার লোককে গাদ্দারে পরিণত করে। মহীশুর বাহিনীর সাথে ইংরেজ বাহিনীর ফয়সালাকারী যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৭৯৯ সালের মে মাসে। ৪ মে ফজরের নামাজ আদায় করে টিপু সুলতান শত্রু বাহিনীর মোকাবেলায় অবতীর্ণ হন। গাদ্দার পরিবেষ্টিত হয়ে তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়। এমনকি তার ব্যক্তিগত ও খাস খাদেম গোলাম রাজা খানও তার সাথে চরম গাদ্দারী করে।তার কাছে পানি থাকা স্তত্বেও সে সুলতাকে পানি দিতে অস্বীকার করে এবং সুলতান সারা দিন পানির পিপাসায় ছটফট করেন। এই গাদ্দারই তাকে দুশমনের হাতে আত্মসমর্পনের কুপরামর্শ দেয়।সে সময় তাকে লক্ষ করেই টিপু সুলতান সেই বিখ্যত উক্তিটি করেন- "আমার কাছে সিংহের একদিন জীবন শিয়ালের শত বছরের জীবনের চেয়ে উত্তম।"

টিপু সুলতানের আমলের একটি দুর্গটিপু সুলতানের আমলের একটি দুর্গ

সকালে অব্যাহত লড়াইয়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।আসমানের বাসিন্দারা আল্লাহর এই মকবুল বান্দাকে ইস্তেকবাল করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। বিকেলের কোন এক সময় মহীশুরের এক গাদ্দার ইংরেজদেরকে ইশারা করে বলে দেয় ইনিই হলেন টিপু সুলতান।তৎক্ষণাৎ দুশমনেরা বন্দুকের সকল নল তার দিকে তাক করে এবং চতুর্দিক থেকে অবিরাম গোলা বর্ষণ হতে থাকে।একটি গুলি এসে তার বুকে বিদ্ধ হয় এবং তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এসময় একজন সৈনিক তার কোমরে ঝুলানো হীরা খচিত শমসীর খুলে নিতে চাইলে তার আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে,তখন তিনি তার সকল শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং তলোয়ার দিয়ে তার উপর আঘাত করেন।সে বন্দুকের সাহায্যে আঘাত প্রতিহত করলেও অন্য একজন ইংরেজ সৈনিক এতে প্রাণ হারায়। সে সময়ে নিকটে অবস্থিত অন্য একজন ইংরেজ সৈনিক তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে তার কানে গিয়ে তা আঘাত করে।এই গুলিতে টিপু সুলতানের শাহাদাত বরণ করেন,সেই সাথে হিন্দুস্তানের আযাদীর সূর্যও অস্তমিত হয়।সে দিনটি ছিল ১৭৯৯ ইংরেজী সালের ৪ ই মে।




পরের দিন ৫ মে তাকে গোসল ও কাফন দেওয়া হয়। লক্ষ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান তাঁকে শেষ বারের মত দেখার জন্য ভীড় করে। হিন্দু মহিলারা মাথায় মাটি নিক্ষেপ করে শোক প্রকাশ করতে থাকে। লালবাগে পৌঁছানোর পর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শহরের কাজী জানাজার ইমামতি করেন। নামাযান্তে মহীশুর রণক্ষেত্র থেকে আট মাইল দূরে সেরিঙ্গা পট্টম নামক স্থানে পিতা হায়দার আলীর কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।

বাব-মায়ের কববের পাশাপাশি শহীদ টিপু সুলতানবাব-মায়ের কববের পাশাপাশি শহীদ টিপু সুলতান

এভাবেই ভারত উপমহাদেশের একজন স্বাধীনচেতা ,দেশপ্রেমিক, লড়াকু সৈনিক ও অকুতোভয় আলেম শাসকের জীবনাসান হয়।

লাল পতাকায় উড়ছে একটি ইতিহাস..........লাল পতাকায় উড়ছে একটি ইতিহাস..........
ব্লগার  “অগ্রপথিক”  এর লেখা থেকে পরিমার্জিত ও নোটাকারে প্রকাশের উপযোগী করে তৈরী করা।

Saturday, May 3, 2014

এক টুকরো হারানো মতি

- No comments
এক টুকরো হারানো মতি ! 
collected from সালাউদ্দিনের ঘোড়া


আজ ইসলামের স্বর্ণযুগের এমনই একজন বিস্ময়কর নাম না জানা মুসলিম যোদ্ধার কথা আমরা আলোচনা করবো যার বীরত্বের তুলনা শুধু মুসলিম কেন, বাকি বিশ্বেই কম আছে।

রাসুলুল্লাহ সাঃ এর ইন্তেকালের পর আরব পেনিন্সুলার বিরাট অংশ জুড়ে ধর্মত্যাগের ফিতনা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। আবু বকরের মতো কোমল হৃদয় মানুষের অনমনীয় দৃঢ়তার ফলে ধর্মত্যাগের বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে নামে মুসলিম বাহিনী। এমন কোন সাহাবা খুঁজে পাওয়া যায় না, যিনি যুদ্ধে অংশ নেননি। এদের নেতৃত্বের ভার আবু বকর রাঃ তুলে দেন অন্যান্য সাহাবাদের তুলনায় পরে ইসলাম গ্রহণকারী খালিদ বিন ওয়ালিদের হাতে, যাঁকে রাসুলুল্লাহ সাঃ ‘সাইফুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর তলোয়ার’ উপাধি দিয়ে গেছেন। সাইফুল্লাহ বা খালিদ বিন ওয়ালিদ সামান্য সেনা নিয়ে বিরাট সব বাহিনীর বিরুদ্ধে অসাধারণ সব বিজয় লাভ করতে শুরু করেন। সমর ইতিহাসের সেরা সব পরিকল্পনা আর বীরত্বের ইতিহাস রচিত হতে শুরু করে খালিদের হাতে। ছোট কিংবা বড় কোন যুদ্ধক্ষেত্রেই পরাজয় নামের কোন শব্দ খালিদের সাথে যায়না। ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধটি হয় ভন্ডনবী মুসায়লামার বিরুদ্ধে। রক্তক্ষয়ী সে যুদ্ধের পর আরব উপদ্বীপের ধর্মত্যাগীদের ফিতনা প্রায় পুরো নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। আবু বকর রাঃ এরপর খালিদকে তখনকার পরাশক্তি পারস্য সাম্রাজ্যে আক্রমণ করার কঠিন অ্যাসাইনমেন্ট দেন। এরই মধ্যে খালিদ বিন ওয়ালিদ দীর্ঘদিনের নিরবিচ্ছিন্ন যুদ্ধে ক্লান্ত তাঁর সেনাদলকে পারস্য আক্রমণের জন্য আদেশ না করে তাদের জন্য তা ঐচ্ছিক করে দেন। ক্লান্ত যোদ্ধাদের অধিকাংশ বিশ্রামের অপশন গ্রহণ করে, যেহেতু তারা প্রায় এক বছরের মতো সময় পরিবারের বাইরে যুদ্ধক্ষেত্রে কাটাচ্ছে।

খালিদ রাঃ এমন পরিস্থিতিতে মদীনায় খলিফা আবু বকর রাঃ এর কাছে আরো সেনা পাঠিয়ে চিঠি লিখেন। আবু বকর রাঃ তাঁর উপদেষ্টাদের সাথে আলোচনারত ছিলেন এমন অবস্থায় খালিদের চিঠি তাঁর হাতে পৌঁছে। তিনি সশব্দে চিঠিটি পড়লেন যাতে সবাই শুনতে পায়। চিঠি পাঠ করার পর আবু বকর রাঃ কা’কা বিন আমর নামে এক যোদ্ধাকে খবর পাঠান।
কিছুক্ষণ পর কা’কা বিন আমর যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে আবু বকরের কাছ হাজির হন। খলিফা তাঁকে অবিলম্বে ইয়ামামায় খালিদের সাথে যোগদান করার জন্য নির্দেশ দেন। খলিফার সঙ্গীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কি একজন ব্যক্তিকে পাঠিয়ে সেই বাহিনীর শক্তি বাড়াতে চান, যার অনেক সৈন্য বিশ্রামে আছে?” আবু বকর রাঃ কিছুক্ষন কা’কা বিন আমরের দিকে তাকিয়ে জবাব দেন, “সে বাহিনী পরাজয় বরণ করবে না, যাতে এই তরুণের মতো যোদ্ধা থাকবে”।

কা’কা খালিদের বাহিনীর সাথে যোগদান করার জন্য বিদ্যুৎ বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন। খালিদের পত্রের প্রেক্ষিতে আবু বকর কা’কা বিন আমর কে একা পাঠানোতে খালিদ কিছুটা বিস্মিত হলেও নিঃসন্দেহ হন, কেননা আবু বকর রাঃ এর বিচক্ষণতা সম্বন্ধে তাঁর কোন সন্দেহ ছিলো না। তিনি কা’কাকে সেনাদলের বিভিন্ন ট্রুপের কমান্ডার নিযুক্ত করেন। সেই থেকে কা’কা প্রমাণ দিতে শুরু করেন কেন তাঁকে একাই একদল সৈন্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কখনো মুসলিম বাহিনীর অগ্রবর্তি দলের নেতা, কখনো গতিময় অশ্বারোহী টহল দলের নেতা, কখনো সম্মুখ যুদ্ধে ডুয়েল লড়াইয়ে কা’কা অসামান্য ক্ষিপ্রতা ও বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তবে তাঁর প্রতিভার সবচেয়ে সেরা প্রমাণ তিনি দেখান তিনি ‘শিকলের’ যুদ্ধে।

পারস্যে মুসলিম বাহিনীর প্রথম বড় যুদ্ধ হলো এই শিকলের যুদ্ধ যা কাজিমা নামক স্থানে সংগঠিত হয়। মুসলিম বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য দাস্ত মেইসানের গভর্নর ও ১ লক্ষ দিরহাম মূল্যের ক্যাপ পরিধানকারী জেনারেল হরমুজ তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে হাজির হয়। তখনকার দিনে পারস্যে সেনা কমান্ডারদের র‍্যাংক ও সম্মান নির্ধারিত হতো ক্যাপের মূল্যের ভিত্তিতে। পাঁচশ-এক হাজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন দামী ক্যাপ ছিলো র‍্যাংক বিন্যাসে। আর এর ভেতর সবচেয়ে দামী ক্যাপটি ছিলো এক লাখ দিরহামের। হরমুজ ছিলো এই এক লক্ষ দিরহাম ক্যাপ জেনারেল। তাঁর সামরিক দক্ষতা ছিলো পারস্য বাহিনীর ইতিহাসে ঈর্ষণীয়। হরমুজ যুদ্ধে পারস্যের যুদ্ধের পূর্বতন ট্রাডিশন অনুযায়ী তার সৈন্যদের গ্রুপে গ্রুপে ভাগ করে পরস্পরকে শিকলের সাহায্যে জুড়ে দেন। এর ফলে সুবিধা ছিলো এই যে, প্রতিপক্ষ বাহিনীর পক্ষে বুহ্য ভেদ করে ঢোকা ভীষণ কষ্টকর হতো এবং তারা সহজেই শেকলের ঘেরাওয়ের ভেতর পড়ে আটকা পড়তো। এছাড়াও পারস্য সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাবার চিন্তা বাদ দিতে বাধ্য হয়ে মরনপণ যুদ্ধ করতো।

শিকলের যুদ্ধের আগেই সমগ্র আরব উপদ্বীপে ও সমগ্র পারস্যে খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ এর বীরত্বগাঁথা ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের মনে এই ধারণা গেঁথে বসতে থাকে যে, যে যুদ্ধে খালিদ থাকবে, সেখানে প্রতিপক্ষের পরাজয় অনিবার্য। আর সেজন্যই হরমুজ যুদ্ধের নিয়ম ভেঙে এক ভয়াবহ পরিকল্পনা আঁটে। যুদ্ধ শুরুর আগের দিন সে তার অন্যান্য জেনারেলদের নিয়ে পরিকল্পনা করে যে, পরদিন সে খালিদকে অস্ত্রহীনভাবে খালি হাতে দ্বৈত যুদ্ধের আমন্ত্রণ জানাবে। খালিদ কাছে এলে আগে থেকে লুকিয়ে থাকা কয়েকজন চৌকশ ঘোড়সওয়ারের একটি দল অতর্কিতে আক্রমণ করে তাঁকে হত্যা করবে। খালিদকে হত্যা করলে মুসলিম বাহিনীর মনোবল নষ্ট হয়ে যাবে আর তখন তাদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। পরিকল্পনা মতো যুদ্ধের দিন অতর্কিতে আক্রমণকারী বাহিনী প্রস্তুত হয়ে থাকে। সবকিছুই প্রস্তুত তাদের পরিকল্পনা মতো। তবে আল্লাহ যেভাবে কুরআনে বলেছেন, “তারা ষড়যন্ত্র করে, আর আল্লাহ্‌ও পরিকল্পনা করেন। আর আল্লাহ্‌ হলেন শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী”, সেদিন সকালে আবার তা আবার প্রমাণিত হয়।
হরমুজ তার বাহিনী থেকে বেরিয়ে খোলা ময়দানে এসে খালিদ রাঃ কে দ্বৈতযুদ্ধের আহবান জানায়। খালিদ রাঃ সে আহবানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন। প্রথমে অস্ত্র সহ দ্বৈত যুদ্ধের সূচনা হয়। উভয়ে উভয়কে মরনপণ আঘাত করতে থাকে কিন্তু একে অপরের আঘাত এড়িয়ে যেতে সক্ষম হন। উভয় মহান যোদ্ধা পরস্পরের নৈপুণ্যে বিস্মিত হন। এক সময় হরমুজ অস্ত্র ফেলে খালিদকে খালি হাতে কুস্তি লড়বার আমন্ত্রণ জানায়। খালিদ সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। কুস্তি শুরু হবার সাথে সাথে হরমুজ খালিদকে শক্ত করে ধরে চিৎকার করে তার গোপন বাহিনীকে সাহায্যের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। খালিদ রাঃ কিছু বুঝে উঠার আগেই পারস্যের অশ্বারোহী একটি দল তাদের ঘিরে ফেলে উদ্ধত অস্ত্র হাতে। খালিদ রাঃ বুঝে ফেলেন তাঁকে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, কিন্তু ততোক্ষণে কিছুই করার নেই। তবে আল্লাহর কৃপায় খালিদ হঠাৎ এমন একটি কাজ করেন যাতে ঘেরাও করা দলটি কিছুক্ষণের জন্য আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। তিনি হরমুজকে চেপে ধরে মাটিতে পড়ে যান এবং অনবরত মাটিতে গড়াতে শুরু করেন। এর ফলে খালিদকে আঘাত করতে গেলে হরমুজ আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে-এই সমস্যার জন্য দলটি আঘাত করা থেকে বিরত থাকে।

ইতিমধ্যে দুই বাহিনী দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে দুরকম প্রতিক্রিয়া দেখায়। পারস্য বাহিনী খুশিতে চিৎকার করে ওঠে আর মুসলিম বাহিনীতে উৎকণ্ঠার নিরবতা ছেয়ে যায়। এমনি সময় কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই সবাই দেখতে পায় মুসলিম বাহিনীর এক ঘোড়সওয়ার বিদ্যুতের মতো এগিয়ে এসে চোখের পলকে হরমুজের গোপন বাহিনীর তিনজনের গর্দান অড়িয়ে দিয়েছে। সামান্য সময়ের ভেতর বাকী অন্য কয়জনও এই যুবকের আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই যুবকই হলেন আবু বকরের পাঠানো একজনের সেনাবাহিনী কা’কা বিন আমর। কা’কা হরমুজের সাথে খালিদের সাথে কুস্তি শুরু হবার পরই চারদিকে চোখ রাখতে শুরু করেন এবং গোপন বাহিনী বেরিয়ে আসার পর পরই ষড়যন্ত্র হচ্ছে বুঝতে পেরে তিনি দ্রুত খালিদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে যান। সেই পরিস্থিতি এত দ্রুত ব্যবস্থা দাবী করছিলো যে, তিনি অন্য কাউকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে তাঁর সাথে এগিয়ে যাবার আহবান জানানোকেও সময় অপচয় বলে ভাবলেন। আর এভাবেই আল্লাহর তাঁর তরবারীকে কা’কার ক্ষিপ্রতার মাধ্যমে রক্ষা করেন। মুসলিম বাহিনী আল্লাহু আকবার বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে।

কা’কার তৎপরতার পর খালিদ উঠে গিয়ে এক আঘাতে হরমুজের জীবন সাঙ্গ করেন। লক্ষ দিরহামের জেনারেল হরমুজকে হারিয়ে মনোবল ভেঙে পড়ে পারস্য বাহিনীর। স্বল্প সংখ্যার মুসলিম বাহিনীকে বিজয় দেন আল্লাহ্‌।
কা’কা বিন আমরের সামরিক দক্ষতার যে ইতিহাস, তা দিয়ে কয়েক ডজন ব্রেভহার্ট ধরণের চলচিত্র তৈরী করা সম্ভব। নিজের দক্ষতাকে প্রচার করতে চাইলে তাঁর নাম ও খ্যাতি আরো ছড়াতো এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে তিনি খ্যাতির জন্য লড়াই করেননি কোনদিন। তাঁর লড়াই ছিলো কেবল আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য। আর তাই ব্যক্তিগত বীরত্বে ভরা তাঁর জীবনে তিনি কোনদিন এসব কৃতিত্বের জন্য গৌরব বোধ করতেন না। সমরাঙ্গনের বাইরে লাজুক ও মুখচোরা ধরণের এই অনন্য সাধারণ লোকটি যুদ্ধের বাইরের সময়টা আল্লাহ্‌র ইবাদতে কাটিয়ে দিতেন। ঘোড়ার পিঠে আর তরবারীর ছায়ায় যেমন ক্ষিপ্র ছিলো তাঁর জীবন, ততোধিক গোপনে ও নিরবে তিনি অশ্রু ঝরাতেন আল্লাহ্‌র কাছে। প্রতিটি রাতের নিকষ কালো আঁধারে।